স্বাধীনতার আগে ও পরে শুধু একটি পার্থক্য হয়েছে। সে হচ্ছে হিজ এক্সেলেন্সির সিকিউরিটি। গভর্নরের ডিভ্যালুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটি ব্যবস্থারও অধঃপতন হয়েছে। একজন ছোঁকরা সাব-ইন্সপেক্টরই এখন মহামান্য রাজ্যপালের একমাত্র ত্রাণকর্তা। অ্যাডভান্স পার্টিতে তাই কোনো সিকিউরিটি অফিসার থাকেন না।
দিল্লীর কিছু হাফ-গেরস্ত, হাফ-সাহেবরা প্রতি সামারে যেমন অন্তত একবেলার জন্য মুসৌরি ঘুরে এসে অক্ষয় প্রেস্টিজের অধিকারী হন, কলকাতার কিছু মানুষের মধ্যেও এ রোগ আছে। টাইগার হিলে গভর্নরের মুচকি হাসি না দেখে কলকাতার কিছু মানুষ পার্ক স্ট্রিটের কেক খেতে পারেন না। গভর্নরের অ্যাডভান্স পার্টি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওঁরাও গরম জামা-কাপড় ইস্ত্রি করা শুরু করেন।
ক্যাপ্টেন এসব জানে। জানে আরো অনেক কিছু। জানে অ্যাডভান্স পার্টি চলে যাবার পরই শুরু হবে বিশ্বনিন্দিত কলকাতা রেডিও স্টেশনের অনুরোধের আসর! যে এ-ডি-সি গভর্নরের সঙ্গে যাবার জন্য থেকে যান, তাকেই এই অনুরোধের আসরের জ্বালা সহ্য করতে হয়। নিয়মিত, প্রতি বছর। বৈচিত্র্য নেই সে অনুরোধে। তাছাড়া এসব রিকোয়েস্ট আসেও ওই একই অতি পরিচিত মহল থেকে। ওরা উত্তর বা দক্ষিণ কলকাতার লোক নন। মধ্য কলকাতারও না; কলকাতায় বাস করেও কলকাতাবাসী নন যাঁরা, সেই লাউডন-রডন-ক্যামাক-ময়রা স্ট্রিটের কিছু মানুষের কাছ থেকেই এসব অনুরোধ আসে, আসবে। ওরা সত্যি বিচিত্র! ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের প্লেনে চড়ে কাঠমাণ্ডু যেতে ওদের প্রেস্টিজে লাগে কিন্তু বিলেত-আমেরিকা গিয়েও ভব্য-সভ্য হবার সুযোগ পান না বিশেষ। তবে হাতের কাছে বি-ও-এ-সি বা প্যান-এমের টাইম টেবিল রাখেন প্রায় সবাই। ফিফথ এভিনিউ বা অক্সফোর্ড স্ট্রিটে সপিং করার সৌভাগ্য না হলেও নিউ মার্কেটের নিন্দায় পঞ্চমুখ।
ওরা আরো অনেক কিছু। কলকাতায় থেকেও বেলেঘাটা নারকেলডাঙ্গা-উল্টাডাঙ্গা দেখেন না। ওরা জলযোগের পয়োধি পেলেও দূরে সরিয়ে রাখেন কিন্তু ক্রেডিটে ফেরাজিনির কেক না খেয়ে পারেন না। স্বপ্ন দেখেন সুইস আলপস্-এর, যান শুধু দার্জিলিং।
অনুরোধ আসে ওই ওদের কাছ থেকে। প্রস্তাবিত, সম্ভাবিত আক্রমণের জন্য ক্যাপ্টেন রায় প্রস্তুত হচ্ছিল।
এই অনুরোধ-উপরোধ নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। কিছু লোককে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট করতে হয় বহুজনকে। এবার তাই ক্যাপ্টেন রায় আগে থেকেই সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে গভর্নরের কাছেই চলে গেল।
স্যার! আই অ্যাম সিওর প্রত্যেক বছরের মতো এবারও বহু রিকোয়েস্ট আসবে…
ডু ইউ থিঙ্ক সো?
ডেফিনিটলি। বহু চিঠিপত্র অলরেডি এসে গেছে। কালকের পেপারে আপনার দার্জিলিং যাবার ডেট অ্যানাউল হবার সঙ্গে সঙ্গে পার্সোন্যাল রিকোয়েস্ট আসা শুরু হবে। দ্যাট ইজ
হোয়াই…
অফিসিয়াল প্রোগ্রাম কতগুলো আছে?
একটা।
ওনলি ওয়ান? অবাক, বিস্ময়, হতাশায় গভর্নর এ-ডি-সির দিকে চাইলেন।
ইয়েস স্যার। খুব নরম গরম গলায় ক্যাপ্টেন রায় জানাল।
দার্জিলিং-এ গভর্নর থাকবেন তিন সপ্তাহ আর সরকারি এনগজেমেন্ট মাত্র একটা? হ্যাঁ। ওই রকমই হয়। দিল্লিতে হোম মিনিস্টারের করকমলে প্রতিদিন প্রতি রাত্রি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে ও চীফ মিনিস্টারের সানুগ্রহে গভর্নর হলে এর চাইতে বেশি অনার পাওয়া যায় না। গভর্নর ও তার এ-ডি-সি দুজনেই একথা জানেন। তাই কেউই আর এ বিষয়ে আলোচনা করলেন না।
সরকারি ভোগ্ৰাম কি?
স্যার, টু গিভ অ্যাওয়ে সার্টিফিকেটস টু গ্রামসেভিকাস।
মর্মাহত হলেন হিজ এক্সেলেন্সি। যারা বি-ডি-ওর আন্ডারে চাকরি করবে, তাদের সার্টিফিকেট দিতে হবে ওকে? তবে সান্ত্বনা এই যে ডেভলপমেন্ট কমিশনার তার বক্তৃতায় নিশ্চয়ই বলবেন, গ্রাম বাংলার রূপ বদলাবে তোমরা-ইউ গার্লস। বি কেয়ারফুল, কি দারুণ রেসপন্সিবিলিটি তোমাদের এবং তাইতো হিজ এক্সেলেন্সি ইউ ভেরি কাইভলি প্রেজেন্ট হিয়ার টু-ডে। কলকাতার। খবরের কাগজে এ অনুষ্ঠানের রিপোর্ট ছাপা না হলেও পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টের কাগজে ছবি ও রিপোর্ট ভালোভাবেই বেরোবে।
সরকারি নেমন্তন্নর অভাবে চুপচাপ তো রাজভনের মধ্যে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে থাকা যায় না। গভর্নর তাই এ-ডি-সিকে বললেন, না, না, ডোন্ট ডিসঅ্যাপয়েন্ট অল অফ দেম্।
বাট স্যার, কতজনকে আর খুশি করতে পারব? তাছাড়া ইউ আর গোয়িং দেয়ার টু টেক রেস্ট।
নো, নো। পাবলিক রিকোয়েস্ট করলে আই মাস্ট ট্রাই টু অনার দেম।
কিছু লোকের তৈল মর্দন পাবার জন্য গভর্নর ব্যাকুল ছিলেন। তাছাড়া কোনো ইনভিটেশন থাকলে ওর ফ্যামিলীর লোকজনই বা ভাববেন কি?
স্যার সেক্রেটারি ওয়াজ সাজেস্টিং যে ডেইলি একটা এনগেজমেন্ট নেওয়াই ঠিক হবে।
শেষে গভর্নর জানালেন যে বেশি অনুরোধ-উপরোধ এলে মাঝে-মাঝে দুটো-তিনটে এনগেজমেন্ট থাকলেও আপত্তি নেই।
দারিদ্র্যের প্রতিযোগিতা নেই কিন্তু ঐশ্বর্যের প্রতিযোগিতার শেষ নেই। গ্রীষ্মের দার্জিলিং-এ দেখা যায় সেই প্রতিযোগিতা। কলকাতার ইমপোর্টেড ব্যবসাদার আর লোক্যাল প্লান্টর্সরা পাগল হয়ে ওঠেন নেশায়। মিস এটা সেনের চারটি পেন্টিং কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিল্পপতি সানইয়াল ওর আর্ট সেলুনের ওপেনিং-এ সভাপতির পদ কিনলেন। কেন? চীফ গেস্ট যে গভর্নর। ওভার নাইট সানইয়াল সাহেবকে নিয়ে মেতে উঠলেন সোসাইটি লেডিরা। দার্জিলিং সামার কুইন প্রতিযোগিতায় ওকে চিফ গেস্ট করার প্রস্তাব এলো বহুজনের কাছ থেকে।