আরতি বলল, চলুন লাঞ্চ খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। উই উইল সেলিব্রেট ইওর বার্থডে।
আমজাদ প্যাকেটটাকে খুলে ঘরে ঢুকতেই মণিকা এগিয়ে গেল, দাও।
আমজাদ ফিরে যাচ্ছিল। মণিকা বলল, দাঁড়াও আমজাদ, চলে যেও না।
প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টি বের করে আমজাদকে দিয়ে বলল, আজ তোমাদের সাহেবের জন্মদিন। তাইতো এই মিষ্টি এলাহাবাদ থেকে মা পাঠিয়েছেন।
আমজাদ হাত তুলে কপালে ঠেকাল, আল্লা সাহেবের ভালো করুন।
যাও এবার তুমি লাঞ্চ দেবার ব্যবস্থা কর।
আমজাদ চলে গেল। মণিকা দুটো মিষ্টি বের করে ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দিল, নিজেরাও দুজনে নিল।
হঠাৎ আমজাদ ফিরে এলো। সাব, দশ মিনিট টাইম নিচ্ছি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
দশ মিনিট নয়, পনের-কুড়ি মিনিট পরে বুড়ো রমজানই প্রথম ঘরে ঢুকল। হাতে একটা বিরাট ফুলের তোড়া। পিছনে আমজাদ, গঙ্গা, নটবর ও তিন চারজন।
ফুলের তোড়াটা ক্যাপ্টেনকে এগিয়ে দিয়ে রমজান বলল, বহুত বহুত মুবারক হো সাব।
গঙ্গার হাতে বিরাট একটা কেক। আমজাদ আর ওরা ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ রাখল।
মণিকা খুব খুশি। আরতিও। ক্যাপ্টেন একটু বিস্মিত। মুগ্ধ।
বড় আনন্দে কাটল সারাদিন। সারা সন্ধ্যা। খাওয়া-দাওয়া হাসি-ঠাট্টা-গান।
শেষে আরতিকে নামিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন মণিকাকে পৌঁছতে গেল। গাড়ি থেকে নামবার আগে মণিকা একটু নীচু হয়ে ক্যাপ্টেনকে প্রণাম করল।
ক্যাপ্টেন মণিকার হাত দুটো চেপে ধরে বলল, একি করছ?
আমজাদ-রমজান কত কি তোমাকে দিল। আমি না হয় শুধু একটা প্রণাম করেই শ্রদ্ধা। জানালাম।
১৩. গভর্নর দার্জিলিং যাবেন
কদিন পরেই গভর্নর দার্জিলিং যাবেন। গ্রীষ্মবকাশে। ডারবি-সায়ারের কেডস্টন হলের অনুকরণে ক্যাপ্টেন ওয়েট যখন কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসের পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন গরমের দিনে এর বাসিন্দাকে পালিয়ে যেতে হবে ভাবেননি। যার জন্য এই প্রাসাদের জন্ম, সেই লর্ড ওয়েলেসলীও কল্পনা করেননি। বিয়াল্লিশ বছরের উন্মত্ত ওয়েলেসলী সব ঋতুতেই সমানভাবে খুশিতে থেকেছেন এই গভর্নমেন্ট হাউসে।
তারপর যুগ পাল্টে গেল। ক্লাইভ স্ট্রিটের সাহেব-সুবাদের সঙ্গ দেবার জন্য ওয়েলেসলির উত্তর সাধকরা দার্জিলিং যাতায়াত শুরু করলেন।
ওয়েলেসলি-কার্জন-বেন্টিকের চৌদ্দ পুরুষকে গালাগালি দিয়ে যারা এই গভর্নমেন্ট হাউস দখল করল, তারাও হয়তো এই ক্লাইভ স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গীর সাহেব-সুবাদের মুখ চেয়েই দার্জিলিং শৈল শিখরে বসে বসে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ঠাট্টা করার লোভ সম্বরণ করতে পারলেন না।
তাই তো লাটসাহেবকে আজও গরমের দিনে পালাতে হয় লর্ড ওয়েলেসলির স্বপ্নের প্রাসাদ ছেড়ে।
কলকাতায় তবু ভিজিটার্স আসে, মিটিং-কনফারেন্স-সেমিনার আছে। ভাগ্য ভালো হলে ঘুষখোর সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের তদারকিতে তৈরি নতুন সরকারি অপকর্মশালার উদ্বোধন করার সুযোগও জুটে যায়। ফটো তোলার আরো অনেক সুযোগ আছে কলকাতায়। কিন্তু দার্জিলিং-এ? থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-ঘোড়। সেই বাজার, মোটর স্ট্যান্ডের পাশে লয়েড জর্জ বোটানিক্যাল গার্ডেনে একদিন ঘুরে-বেড়ান, ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে গিয়ে বোকার মতো হাঁ করে থাকা, অবজারভেটরি হিল-এ গিয়ে ঘোমটা দেওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা।
দার্জিলিং-এ লাটসাহেবের আরো কিছু কম আছে। একদিন লেবং-এর রেস কোর্সে গিয়ে খচ্চরের দৌড় দেখে হাসি মুখে কোনো মাতাল জুয়াড়ির হাতে কাপ-মেডেল তুলে দিতে হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার মতো এগুলো সব লাটসাহেবকেই করতে হয়। সরকারি ভাষায় প্রিসিডেন্ট। হয়ে গেছে। প্রিসিডেন্ট-এর মতো কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ছাড়াও লাটসাহেবকে আরো আরো কিছু পূজা-পার্বণ-ব্রত পালন করতে হয় শৈল শিখরে গিয়ে। কোটিপতি পাটের দালালেরা মেয়ের। আর্ট একজিবিশন ওপন করতে হয়। ইনভিটেশন কার্ডে অবশ্য লেখা থাকে ওপনিং অফ আর্ট সেলুন। একবার-আধবার ক্যাপিট্যাল থিয়েটার বা রিস্ক সিনেমায় গিয়ে কিছু ব্যভিচারিণীদের চ্যারিটি শো-তে মদত করতেও হয় লাটসাহেবকে। এসব না করলে বর্ষায় তিস্তা ভদ্র হয়ে উত্তর বাংলার মানুষদের শান্তিতে থাকতে দেবে, এমন কোনো কারণ নেই। তবু করতে হয়। করতে হয় বাজেট বরাদ্দের কয়েক লক্ষ টাকা হরির লুঠের বাতাসার মতো উড়াবার জন্য। হাজার হোক সারা বাংলার জনপ্রতিনিধিদের পাশ করা বাজেটের তো একটা প্রেস্টিজ আছে?
তেনজিং হিমালয়ের ছাদে চড়ার পর সারা দেশের ভি-আই-পিদের মতো লাটসাহেবকেও পাহাড়-প্রেমিক হতে হয়েছে। যে লাটসাহেব দার্জিলিং বা বেনারসের কোনো পুরনো সিঁড়ি দিয়ে দু-ধাপ উঠতে পারেন না, তাকে মাউন্টিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপালের তৈরি তিন পাতা টাইপ করা বক্তৃতা রিডিং পড়ে পর্বতারোহণে উৎসাহ দিতে হয় একদল ছেলেমেয়েকে।
আগের দিনে জমিদারবাবুরা আদুরে বারবনিতা গোলাপির বিড়ালের বিয়েতে লক্ষ টাকা ওড়াতেন। একালে লাটসাহেবের ফালতু লাটসাহেবিপনায় লক্ষ লক্ষ টাকা উড়ছে বলেই বোধহয় জমিদারের বিড়ালের বিয়ে বন্ধ হয়েছে।
যে যাই হোক। লাটসাহেব রওনা হবার পনের দিন আগেই অ্যাডভান্স পার্টি চলে গেছে। দার্জিলিং রাজভবনেও বহু ছোট-বড় মাঝারি কর্মচারী আছেন। তারা সব কিছুই জানেন। সবকিছু ব্যবস্থাই করতে পারেন। তবু অ্যাডভান্স পার্টিকে যেতেই হয়। বিড়ালের বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য অ্যাডভান্স পার্টিতে ডেপুটি সেক্রেটারি ও এ-ডি-সি লেফটন্যান্ট ভাটিয়া আর কিছু অফিস স্টাফ চলে গেছে।