ঘরে ঢুকেই মণিকা দরজা বন্ধ করল।
দরজা বন্ধ করছিস কেন?
মণিকা সে কথার জবাব না দিয়ে আরতিকে টেনে এনে পাশে বসাল!
বলাইদার কথা তো আগে বলিসনি?
তুই কি জানতে চেয়েছিস?
লুকিয়ে চুরিয়ে কথা বলার বালাই নেই আরতির। তাছাড়া ভিক্টোরিয়া ছাড়ার পরই তো রেঙ্গুনে চলে গেলি…
সব কথা খুলে বলেছিল আরতি। সেফ ডিপোজিট ভল্ট বা ফিক্সড ডিপোজিটে ওর বিশ্বাস নেই। ইন্টারেস্ট নেই। আরতি যেন জীবন্ত কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। জীবনের সম্পদ গচ্ছিত রাখে না, সঙ্গে সঙ্গে চেক কেটে উইথড্র করে বলে দেয় বন্ধুদের। মণিকাকে।
বি-এ পাশ করার পরই বড়দা কলকাতা এসে গেলেন। আমি এখান থেকেই ইউনিভার্সিটি যাতায়াত করতাম। একদিন…।
কী ভীষণ বৃষ্টি হলো! ট্রাম-বাস তো দুরের কথা মানুষের হাঁটা চলা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। ওই টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে একদল চলে গেল ওয়াই-এম-সি-এ রেস্টুরেন্টে। আরতি, শুভ্রা, জয়া আর সঙ্ঘমিত্রা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল মেট্রো। মার্লিন ব্র্যান্ডোর টি হাউস অফ দি আগস্ট মুন দেখতে।
ইন্টারভ্যালের সময় ইনার-লবিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পপকর্ন খাবার সময় হঠাৎ বলাইদার সঙ্গে দেখা।
আরে বলাইদা যে।
বলাইদা খুশি হলেন আরতিকে দেখে। ভুলে যাওনি দেখছি!
ভিক্টোরিয়ায় পড়বার সময় আপনার এত চকলেট-কেক-পেস্ট্রি খাবার পরও ভুলে যাব?
আরতি আলাপ করিয়ে দিল, এরা আমার বন্ধু। শুভ্রা, জয়া, সমিত্রা। সবাই একসঙ্গেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি।
এবার বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, আওয়ার ইউনিভার্সাল বলাইদা! আসলে মণিকার বলাইদা হলেও উই হ্যাঁভ এনজয়েড হিজ জেনরসিটি টু অফ।
ডোন্ট সে অল দি।
সিনেমা শেষ হবার পর বলাইদা ওদের চারজনকে নিয়েই গ্রান্ডে গেলেন। ওর ঘরে। চ-কফি-স্ন্যাকস-এ সেন্টার টেবিল ভরে গেল।
জয়া বলল, এই এত?
আরতি সাবধান করে দেয়, ডোন্ট আগুঁ! বলাইদা গত জন্মে আমাদের ঠাকুমা ছিলেন। তাই একটু ভালো করে না খাইয়ে শান্তি পান না।
আরতি হাসে। বলাইদা ওর মাথাটা ধরে একটা ঝুঁকুনি দিয়ে বললেন, হাসতে শুরু করলে তো!
আবার হাসতে হাসতে আরতি বলে, দিন, দিন একটু ভালো করে মাথাটা ধরে ঝাঁকুনি দিন তো! আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট-এর হাতে ঝাঁকুনি খেয়ে যদি ব্রেনটা একটু সতেজ হয়।
কয়েকদিনের জন্য কলকাতা এসেছিলেন বলাইদা। চা-কফি খাইয়ে বিদায় দেবার সময় বললেন, কালকে একবার টেলিফোন করবে তো?
কখন?
এনি টাইম ইউ লাইক।
পরের দিন দুপুরের দিকে একটা ক্লাশ করেই আরতি ইউনিভার্সিটি থেকে চলে গিয়েছিল বলাইদার হোটেলে। বেশ লাগল। এত বড় হোটেলে আসার একটা রোমাঞ্চ আছে বৈকি! ছাত্রজীবনে যে আনন্দ, যে সম্মান পাবার নয়, আরতি তাই পেয়েছে। খুব খুশি।
সেই চির-পরিচিত হাসিটি সারা মুখে ছড়িয়ে বলাইদাকে বললে, এসে গেছি তো?
একটু আদর করে বলাইদা বললেন, এই হাসিটুকু এনজয় করার জন্যই তো আসতে বলেছি।
আরতি আরো খুশি হয়।
তারপর লাঞ্চ। ওই ঘরে বসেই। ঠিক খিদে না থাকলেও আরতি বিশেষ আপত্তি করল না। খেতে খেতে হাসি-ঠাট্টা।
তোমার হাসি আমি মুভিতে তুলে রাখব।
মুভিতে?
মুভিতে আরতিকে ধরা হলো। তার হাঁটা-চলা ওঠা বসা! সব কিছু।
একেবারে ওই কোণা থেকে একবার জোরে জোরে এদিকে এসো তো।
এবার টায়ার্ড হয়ে গেছি। আর পারছি না।
এখনই টায়ার্ড?
কাল বৃষ্টিতে ভিজে সারা শরীরটা বেশ ব্যথা হয়েছে।
ব্যথা? বলাইদা মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবলেন। সেকথা আগে বলনি কেন?
…জানিস মণিকা, এক গেলাস গরমজলে কি একটা ওষুধ মিশিয়ে বলাইদা আমাকে খেতে দিলেন। বললেন পনের-বিশ মিনিট রেস্ট নাও। সব সেরে যাবে।
তারপর? মণিকা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতে থাকতে জানতে চায়।
আস্তে আস্তে ঔষুধটা খেলাম। সারা শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠল। আর শুরু হলো আমার হাসি। কথায় কথায় হাসি। আমি বেশ বুঝতে পারলাম বলাইদা আমার কাছে এসেছেন, কথায় কথায় আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন, আদর করছেন…
তুই কিছু বলছিলি না?
না। কেমন যেন একটা নেশার ঘোরে মজা লাগছিল। তাছাড়া কথায় কথায় এত হাসি পাচ্ছিল যে কি বলব?…
তোকে কি হুইস্কি-টুইস্কি খাইয়েছিলেন?
তা জানি না রে। বোধহয় ব্র্যান্ডি! নিশ্চয়ই ডোজটা বেশ বেশি ছিল আর তাই আমার নেশা হয়েছিল।
আরতি একটু থামে। একবার ভালো করে মণিকাকে দেখে নেয়।
আমার পর খুব ঘেন্না হচ্ছে, তাই না?
মণিকা একটু হাসে। বোধহয় একটু কষ্ট করেই হাসে। ঘেন্না হবে কেন? যে বন্ধু এমন গোপন কথা খুলে বলতে পারে, তার পর রাগ হয়?
আরতি আবার শুরু কর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সারা শরীর দিয়ে আগুন বেরোতে শুরু করল। নিজেই বোধহয় কিছু কাপড়-চোপড় সরিয়ে বড় কৌচটায় শুয়ে পড়লাম। মনে আছে বলাইদা আমাকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন…
হতচ্ছাড়ি মেয়ে কোথাকার! মণিকা যেন স্বগতোক্তি করে।
আরতি খিল খিল করে হাসে। কি করব বল? আই ওয়াজ হেলপলেস।
থাক থাক! আর শুনতে চাই না তোর কীর্তি।
খুব রেগে গেছিস তো?
রাগব কেন?
আমার কীর্তি-কাহিনি শুনে রাগ হয়নি?
না।
তবে অমন করে কথা বলছিস কেন?
তাইতো? মণিকা নিজেই যেন একটু অবাক হয়। হাত দিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরের শূন্য আকাশ দেখতে দেখতে উত্তর দিল, হয়তো দুঃখে।
কিসের দুঃখ কার জন্য দুঃখ?