পুরো চা না খেয়েই নেমে গেল মণিকা।
হ্যালো…
কিরে তোর যে কোনো পাত্তাই নেই?
ক্যাপ্টেন নয়?
কে বলছিস?
আজকাল কথা শুনেও বুঝতে পারিস না?
সত্যি বুঝতে পারেনি মণিকা। একে ঘুম থেকে উঠেছে, তারপর ভেবেছিল গভর্নমেন্ট হাউস থেকে ফোন এসেছে। তাছাড়া ভিক্টোরিয়ার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ নেই বললেই চলে। কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে, তার ঠিকঠিকানাই নেই। দুচারজন ছাড়া আর কেউ কলকাতা নেই। আরতির সঙ্গে কদিন আগেই হঠাৎ দেখা হয়েছিল। তারপর ও কয়েকদিনের জন্য আবার দার্জিলিং চলে গিয়েছিল।
ঘুম থেকে উঠেই তোর টেলিফোন ধরতে এলাম আর তুই বকতে শুরু করেছিস?
এখন ঘুম থেকে উঠলি?
তবে কি? আমি কে তোদের মতো প্রিজনার হয়ে গেছি?
ওসব বীরত্ব অন্যকে দেখাস। বল, কখন আসছিস?
তুই আয় না।
না, না তুই আয়। অনেক কথা আছে।
মণিকা উত্তর দেবার আগেই আরতি আবার বলে, দেরি করবি না কিন্তু? আর মাসিমাকে বলে আসিস কখন ফিরবি ঠিক নেই।
তার মানে?
আয় না! দুজনে বেরিয়ে পড়ব।
নট এ ব্যাড আইডিয়া বাট…
আরতি আর কথা বাড়ায় না। আর বকতে পারছি না, তাড়াতাড়ি চলে আয়।
টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রাখার পর মণিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। কাল রাত্তিরের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল উৎকণ্ঠা ভরা প্রতিটি প্রহরের কথা, প্রতিটি মুহূর্তের বেদনা, জ্বালা।
ভেবেছিল ভোরবেলায় উঠেই ফোন করবে, দরকার হলে একবার ছুটে গিয়ে দেখে আসবে।
ভোরবেলায় সম্ভব না হলেও একটু বেলা হলে নিশ্চয়ই যেত কিন্তু…
আরতির টেলিফোন এসেই সব গোলমাল হয়ে গেল। তবে…
হয়তো মনটা একটু হালকা হবে। একটু হাসি ঠাট্টা করে কিছু সময় কাটবে। নিজের কাছ থেকে নিজেকে আর এমন করে লুকিয়ে রাখতে হবে না। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য।
তাছাড়া আরতি ওর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ভিক্টোরিয়ায় পড়ার সময় ওরা পাশাপাশি ঘরে থাকত। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া হলেই মাঝে মাঝে চলে যেত ওই লনের কোণায়। কত কথা, কত গল্প, গান হতো দুজনের।
বাংলার লেকচারার প্রফেসর রায়চৌধুরি আরতিকে একটু বেশি খাতির করতেন বলে অনেকেই সন্দেহ করত। ঠাট্টা তামাসাও করত। আরতি সবার কাছে স্বীকার করতে চাইত না কিন্তু রাত্রিবেলায় লনের ওই কোণায় বসে মণিকার সঙ্গে গল্প করতে করতে জানতে চাইত, আচ্ছা মণিকা তোর কি মনে হয় রে?
আগে বল তোর কি মনে হয়?
হঠাৎ আরতি চঞ্চল হয়ে উঠত, জানিস আজকে কি হয়েছে?
কি?
আমি লাইব্রেরির ওই ভেতরের ঘরটায় একটা রেফারেন্স বই দেখতে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা…
ওখানে আর কেউ ছিল?
না!
তোকে কিছু বললেন নিশ্চয়ই।
হঠাৎ আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, চেহারাটা প্রতিদিনই আরো বেশি সুন্দর হচ্ছে, এবার পড়াশুনাটাও একটু…
মণিকা উত্তেজনায় আরতির হাতটা চেপে ধরে বলল,
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে–
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে।
সে সব দিনের কথা মনে হতেই মণিকা আপন মনে হাসতে হাসতে বার্মিজ ছাতাটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
হাসিমুখেই আরতি অভ্যর্থনা করল। ওটাই ওর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে আরতির। একে সুন্দরী তারপর হাসি-খুশি। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত! হয়তো প্রফেসর রায়চৌধুরিকেও। হয়তো আরো কাউকে। বা অনেককেই। পিছলে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়েছে। সব সময়ই?
প্রাণ খুলে হাসতে হাসতেই সব কথা বলত মণিকাকে। আরতির সব কিছু মেনে নিতে পারত। তবুও ভালো লাগত, ভালোবাসত।
এখনও কি সবার কাছেই এমন হি-হি করে হাসিস?
হাসব না কেন?
এত রূপ আর এত হাসি, ভালো না! কোনোদিন যে বিপদে পড়বি!
দরজা দিয়ে বারান্দায় পা দিয়েই মণিকা বলল।
আরতি হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বিপদে যে পড়িনি সেকথা তোকে কে বলল?
পড়েছিস?
পড়ব না?
কার কাছে রে?
আরতি এবার মোড় ঘুরতে চায়, চল চল, উপরে চল।
আগে বল কার কাছে বিপদে পড়েছিস।
আঃ তুই উপরে চল না!
আই উইল নট মুভ অ্যান ইঞ্চ আনলেস…
আরতি হাসতে হাসতে, মণিকার কানে ফিসফিস করে বলল, যদি বলি তোর বলাইদা!
বলাইদা। প্রায় আঁতকে ওঠে মণিকা।
কেন বলাইদা কি ভগবান?
কোন জবাব দেয় না মণিকা। মুহূর্তের জন্য যেন পাথর হয়ে গেছে। মাথাটা যেন ঘুরে উঠল।
আরতি একটু পরে আবার বলল, তোর তো ধারণা বলাইদা একটা ডেমি-গড। বাট আই সে হি ইজ জাস্ট এ ম্যান।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কোনো কথা হলো না। সিঁড়ি দিয়ে আরতির বড়দা নেমে এলেন, কেমন আছ মণিকা?
অনেকদিন পর বড়দাকে দেখে ভালো লাগল। সব চাইতে ছোট বোনের বন্ধু বলে স্নেহ করতেন ওকে।
মণিকা তাড়াতাড়ি একটা প্রণাম করল। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন।
ভালোই আছি, তবে বয়স হয়েছে তো!
বড়দা শেষে বললেন, এখন অফিস যাবার সময়। কথাবার্তা বলতে পারলাম না। আর একদিন এসো।
আসব।
বড়দা গাড়িতে উঠে চলে গেলেও মণিকা ওই দিকেই চেয়ে রইল।
কি রে কি দেখছিস?
ঘাড় নাড়তে নাড়তে মণিকা উত্তর দেয়, কিচ্ছু না।
তবে ওদিকে চেয়ে আছিস যে?
ভাবছি…
কি ভাবছিস?
বড়দার কথা।
আরতি কিছু বলল না। বড়দাকে ওরা সবাই ভীষণ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
উপরে থেকে আরতির মা ডাক দিলেন, কি রে তোরা ওপরে আসবি না?
আর দেরি করে না। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল দুজনেই।
আরতির মাকে প্রণাম করে মণিকা চলে গেল ওই বহুদিনের পরিচিত কোণার ঘরে। আরতির। ঘরে। কতদিন কাটিয়েছে এই ঘরে। কত স্মৃতি জমে আছে এই ঘরে!