মণিকা ভীষণ রেগে যেত।
ক্যাপ্টেন হাসত। হাসতে হাসতেই ও মণিকার গাল দুটো চেপে ধরে বলত, জ্বলব না বলেই তো ভগবান তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।
বাজে বকো না।
বাজে না মণিকা। তা না হলে ঠিক এই সময়েই এখানে আসবে কেন?
সেকথা ভেবে মণিকা আর শান্তি পায় না। দূরের আকাশের ওই তারাগুলো যেন হঠাৎ একটু বেশি দপদপ করে জ্বলতে শুরু করেছে।
জানালার কাছে সরে আসে কিন্তু বিছানাতেও ফিরে যেতে পারে না। পায়চারি করে ঘরের মধ্যে।
কিন্তু এখন এই রাত্রিতে কে ওর ঘরে গিয়ে দেখবে জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে কিনা? বেয়ারা-চাপরাশীরাও তো আর এখন ওর ঘরে যাবে না।
হা ভগবান। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মণিকা। কি বিশ্রী অশান্তি!
বিছানার উপর বসে বসে এবার ভাবে। হঠাৎ নিজের উপরই রাগ হয়। নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। এতদিন পর কত ক্লান্ত হয়ে এলো। তবুও তো আমি ওকে কিছু খেতে দিলাম না। নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছিল। শুধু এক কাপ কফি খাইয়েই…
আচ্ছা ও কি ভেবেছিল এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবে? এমন সময় এলে তো মা কোনদিন খাইয়ে ছাড়েন না! তাছাড়া ও তো জানত না মা নেমন্তন্নে গেছেন। আমজাদ-রমজনেকেও হয়তো বলে এসেছিল ডিনার খাবে না।
দুটো হাঁটুর ওপর মুখ রেখে চুপচাপ বসে থাকে মণিকা। চুপচাপ বসে থাকলেও মনের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন চলে অবিশ্রান্ত ধারায়।
কি বিশ্রী অশান্তি! সোল আনা দুশ্চিন্তা আছে, সে দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্ত হবার ক্ষমতাও আছে কিন্তু নেই সে সুযোগ। এক বিচিত্র অনুভূতি। সব কিছু থেকেও কিছু করার নেই।
আচ্ছা একবার টেলিফোন করলে হয় না? নিজে যখন যেতে পারছি না তখন অন্তত টেলিফোনেও বলতে পারি, ইউনিফর্ম পরেই ঘুমোচ্ছ নাকি? পায়ের জুহোমোজাও নিশ্চয়ই…
শেষে বলতে পারত, আর কত কাল আমাকে এমন দুশ্চিন্তা ভোগ করতে হবে বলতে পার?…
কিন্তু টেলিফোন তো নীচে। পাশের ঘরেই বাবা-মা ঘুমোচ্ছেন। বারান্দার কোণায় তো আবার চাকরটা শুয়ে থাকে। অন্ধকারে পা টিপে টিপে না হয় নীচে গেলাম। তবুও টেলিফোন করতে হলে তো আলো জ্বালাতেই হবে। তাছাড়া ও ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ। বাইরের একটু আবছা আলো আসারও পথ নেই।
আলো জ্বাললেই তো জানাজানি হয়ে যাবে। চাকরটা উঠে পড়বে, বাবা-মা টের পেতে পারেন। কি কৈফিয়ত দেব ওদের?
অন্ধকারে টেলিফোন করতে পারব না? কোনো কিছুতে ধাক্কাটাক্কা খেয়ে পড়ব না তো?
তাহলে তো আরো কেলেঙ্কারি! বাড়িতে মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না।
আর যেন ভাবতে পারে না। মণিকা ছটপট করে। বিছানা ছেড়ে আবার জানালার ধারে। দাঁড়ায়। চারধারে তাকিয়ে দেখে। নিস্তব্ধ পৃথিবী। দিনের অশান্তি, দাপাদাপি নেই। বাতাসে আগুনের হলকা নেই। দিনের বেলায় অজস্র লালসার মোহে পাগলের মতো যারা ছুটে বেড়ায়, তারাও ঘুমোচ্ছে। দীন-দরিদ্রের দল সারাদিন ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করেছে, দিনের শেষে কোনোমতে একমুষ্টি অন্ন পড়েছে ওদের পেটে কিন্তু এই গভীর রাত্রিতে তারাও ঘুমোচ্ছ। কেউ প্রাসাদে, কেউ ফুটপাথে। তা হোক না। চিন্তা-ভাবনা-দুশ্চিন্তা থেকে এখন সবার ছুটি। ঠগ-জোচ্চোর লম্পট-বদমাইশরাও আর জেগে নেই।
দরজা খুলে ছাদে বেরিয়ে আসে মণিকা। একবার বৈকুণ্ঠবাবুর বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে।, ওদের ঘরেও আলো জ্বলছে না। বৌদি তাহলে রোগের জ্বালা থেকেও একটু ছুটি পেয়েছেন, একটু ঘুমিয়েছেন।
অন্যদিন যখনই ঘুম ভেঙেছে, তখনই দেখেছে ওদের ঘরে আলো জ্বলছে। একেবারে শেষ রাত্তিরের দিকেই তো উনি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হন। তবে কি রাত অনেক হলো?
ছাদের এদিক-ওদিক ঘুরে মণিকা আবার ফিরে আসে ঘরে। ওই জানালার ধারে। একটু দাঁড়ায়, একটু পায়চারি করে, আবার একটু বসে।
তবে কি একবার আলো না জ্বালিয়েই পা টিপে টিপে নেমে যাব? খুব আস্তে আস্তে ফিসফিস করে কথা বললে কি কেউ শুনতে পাবে?
শেষ পর্যন্ত অন্ধকারেই টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। শেষ ধাপ পর্যন্ত নেমে গেল কিন্তু বারান্দায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। চাকরটা কোথায় শুয়ে আছে? এই এত রাত্রে এত অন্ধকারে যদি চাকরটার উপর গিয়ে পড়ে? তাহলে ও কি ভাববে?
তাছাড়া…
তাছাড়া আবার কি? ও যদি বলাইদার মতো মুহূর্তের জন্য পাগল হয়ে ওঠে? কিচ্ছু বলা যায় না। হাজার হোক পুরুষ! ঠিক জোয়ান না হলেও প্রৌঢ় নয়। বড় সর্বনাশা বয়স। এই রাত্রের অন্ধকারে ও নিজেকে বাঁচাবে কেমন করে? লজ্জায় চিৎকার পর্যন্ত করতে পারবে না।
ফিরে যাব? নীচে এসেও ফিরে যাব?
আবার আস্তে আস্তে উপরে উঠে যায় মণিকা। পিঠে দুটো বালিশ দিয়ে একটু কাত হয়ে বসে বিছানায়। ঠিক করল ভোর হতে না হতেই টেলিফোন করবে ক্যাপ্টেনকে। তারপর দেখা হলে বলবে, যাকে ভালোবাস তাকে কাছে টেনে নেবার পৌরুষটুকুও তোমার নেই?
মনে মনে রিহার্সাল দেয় মণিকা।
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। চাকরটার ডাকাডাকিতে।
চোখ মেলেই চাকরটাকে দেখে চমকে উঠে মণিকা! মুহূর্তের জন্য রাত্রের বিভীষিকার কথা মনে আসে।
পাশ ফিরতেই এক টুকরো রোদ্দুর চোখে এসে পড়ায় হুঁশ ফিরে আসে।
চা এনেছিস?
হ্যাঁ এইতো।
রেখে যা।
পাশ ফিরে শুয়ে চায়ের কাপে এক চুমুক দিতে না দিতেই মা এসে বললেন, হারে তোর টেলিফোন।
আমার টেলিফোন?
মা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তোর টেলিফোন। তাড়াতাড়ি আয়।