সে কথার জবাব দেয় না মণিকা। শুধু বলে, তুমি আমাকে খুব ভালোবাস, তাই না?
ক্যাপ্টেনের মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। তাই নাকি?
সেই আবছা অন্ধকারেই জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়া সামান্য আলোতেই দেখা গেল মণিকার মুখেও বেশ একটা চাপা তৃপ্তির হাসি।
তুমি এত ভালো কেন বলতো?
তুমি খারাপ হতে দাও না বলে।
যদি কোনোদিন না দিই?
তোমারই লোকসান
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মণিকা বললে, ঘোড়ার ডিম!
হঠাৎ খুব জোরে বেল বেজে উঠল। চমকে উঠল দুজনে।
মণিকা তাড়াতাড়ি উঠে বসে আলতো করে খোঁপাটা বাঁধতে বাঁধতে বললে, চাকরটা এসেছে নিশ্চয়ই।
প্রায় সারা বাড়ি অন্ধকার। শুধু নিচের বারান্দায় একটা আলো। দুজনেই একটু লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো।
ক্যাপ্টেন চলে গেল ডক্টর ব্যানার্জির স্টাডিতে। মণিকা টেবিল ল্যাম্পটার সুইচ টিপেই দরজা খুলতে চলে গেল।
দরজা খুলেই মণিকা চিৎকার করে বললে, এই তোর এক্ষুনি আসা হলো? তাড়াতাড়ি দুকাপ কফি কর।
মণিকা স্টাডিতে আসতেই ক্যাপ্টেন বললে, তুমি তো দারুণ মেয়ে!
একটু অবাক হয়ে মণিকা জানতে চাইল, কেন?
ক্যাপ্টেন সে কথার জবাব না দিয়ে হাসতে হাসতে বললে, তোমাকে দেখে যতটা সহজ-সরল মনে হয় তুমি তা না।
মণিকার মনে খটকা লাগে। ওর অতীত জীবনের কোনো ইঙ্গিত পেল নাকি?
একটু চিন্তিত হয়ে ভ্রু কুঁচকে মণিকা জানতে চাইল, এতদিন পর হঠাৎ একথা বলছ?
নিজের অন্যায় ঢাকা দেবার জন্য চাকরটাকে বেশ সুন্দর ধমক দিলে তো!
মণিকা আশ্বস্ত হয়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, অন্যায় আমার না তোমার?
আমি কি অন্যায় করলাম?
আমাকে একলা পেয়ে তোমার এমন সময় আসাটাই অন্যায় নয়?
সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন জবাব দিল, দরজা দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই তুমি গলা জড়িয়ে ধরবে বলেই তো এলাম।
রবিশঙ্করের সেতারের সঙ্গে এ যেন আল্লারাখার তবলা! যেমন প্রশ্ন তেমন জবাব।
টেবিলের ওপাশ থেকে মণিকা এ-পাশে এসে দুহাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের মুখটা চেপে ধরে বলে, বার বার বললে আর কোনোদিন অমন করে কাছে টেনে নেব না।
মণিকার হাতটা সরিয়ে ক্যাপ্টেন একটু চাপা গলায় জানতে চাইল, বার-বার না বললে রোজ রোজ অমন করে আদর করবে তো?
জানি না।
কফি এলো। ঘরের কোণায় বড় সোফাটার সামনের টেবিলে কফির কাপ দুটো নামিয়ে রেখে চাকরটা জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি কিছু খাবেন?
না।
সারাদিনই তো কিছু খেলেন না।
তুই যা। তোর আর মাতব্বরি করতে হবে না।
চাকরটা চলে গেল।
কি ব্যাপার খাওনি কেন?
তোমার জন্য।
আমার জন্য?
আবার কি? তুমি একলা একলা স্ফুর্তি করবে, ঘুরে বেড়াবে আর আমি এখানে একলা-একলা…
মণিকা আর বলতে পারে না।
নিঃসঙ্গতার এত বেদনা? ক্যাপ্টেন জানত না, ভাবত না।
মাসিমা-মেসোমশাই কোথায়?
নেমন্তন্নে গেছেন।
তুমি গেলে না?
না।
কি বললে?
বললাম শরীর খারাপ।
ক্যাপ্টেন একটু ভাবল। কফির কাপে একবার চুমুক দিল।
চল একটু ঘুরে আসবে।
এখন?
হ্যাঁ।
ফিরতে ফিরতে তো অনেক রাত হয়ে যাবে।
কখন ফিরতে চাও?
কিন্তু বাবা-মার সঙ্গে বেরুলাম না…।
শেষ পর্যন্ত সেদিন আর বেরুল না। ঠিক হলো পরের দিন বেরোবে। ক্যাপ্টেন হাতের প্যাকেটটা মণিকাকে দিয়ে বললে, এটা মাসিমাকে দিও।
ক্যাপ্টেন ফিরে এল রাজভবনে। বড় কৌচটায় হেলান দিয়ে শুয়ে-শুয়ে পরপর দুটো সিগারেট খেল।
চুপচাপ শুয়ে-শুয়ে কত কি ভাবছিল ক্যাপ্টেন। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। তা নিজেও বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর বিরাট ট্রে করে আমজাদ ডিনার নিয়ে এসে দেখল এ-ডি-সি সাহেব ঘুমোচ্ছেন। দু-একবার ডাকল। শেষ পর্যন্ত জবাব না পেয়ে আবার ওই ট্রে নিয়েই ফিরে গেল।
১২. ক্যাপ্টেন ঘুমিয়ে পড়ে
ক্যাপ্টেন ঘুমিয়ে পড়ে। হারিয়ে ফেলে সারাদিনের স্মৃতি। সুখ দুঃখ আনন্দ-বেদনা সোহাগ-ভালোবাসার স্মৃতি।
মণিকা?
দোতলার ওর ঘরে শুয়ে শুয়ে দূরের আকাশের অজস্র তারা দেখে আর হারিয়ে যায় নিজের স্মৃতির অরণ্যে। ঘুমোতে পারে না। কিছুতেই না। অনেক চেষ্টা করেও পারে না। ভাবে। কত কিছু, কত কিভাবে। আকাশ-পাতাল ভাবে।
ভাবে ক্যাপ্টেনকে। নিশ্চয় পায়জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জিটা পরে উপুড় হয়ে দুটো বালিশ জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। নাকি ওই মোটা মোটা খাকির ইউনিফর্ম পরেই ঘুমোচ্ছে? কিছু বিচিত্র নয়। হয়তো ঘামে সমস্ত জামা-কাপড় ভিজে গেছে! হয়তো…
ভীষণ অস্বস্তিবোধ করে মণিকা। এপাশ-ওপাশ করল কয়েকবার। একবার উঠে বসে। বিছানা ছেড়ে একবার জানালার ধারে দাঁড়ায়!
দুর থেকে একটা তারা ছিটকে পড়ল? নাকি চোখের ভুল?
মনটা আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনটা ছটপট করে।
ও কি খেয়েছে?
ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে নিজেই মাথা নেড়ে বলে না, না। এতদিনের ট্যুরের পর আজই ফিরেছে। ফিরেই তো চলে এসেছে আমার কাছে। রাজভবনের ফিরতে ফিরতেও বেশ রাত হয়ে গেছে। এত ক্লান্তির পর আর কি ইউনিফর্ম ছেড়ে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করতে পেরেছে?
নিশ্চয়ই অত ঝামেলার মধ্যে যায়নি। বড় কৌচটায় কাত হয়ে সিগারেট খেতে খেতে ঘুম এসে গেছে।
জ্বলন্ত সিগারেটটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েনি তো?
কতদিন দুপুরে গিয়ে দেখেছে সিগারেট খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেছে কার্পেটের ঠিক পাশেই। আচ্ছা যদি কার্পেটের উপর পড়ত? কার্পেটে আগুন লাগলে কি সর্বনাশ হতো বলো তো?