ওঁরা চলে গেলেন। মণিকা ডক্টরের স্টাডিতে গিয়ে বসল। চাকরটা ঘরদোর ঠিক করতে ভিতরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে চাকরটা এসে একটু ছুটি চাইল। দিদিমণি, আমি একটু ঘুরে আসব?
হাতের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললে, যা। তাড়াতাড়ি আসিস।
দরজাটা আটকে দেবেন।
দিচ্ছি।
একটু পরে দরজাটা বন্ধ করে আসতে আসতেই টেলিফোন বেজে উঠল।
কি হলো তুমি এলে না?
না।
শরীর খারাপ?
হ্যাঁ।
একটু ঘুরে গেলে মন ভালো লাগত না?
না।
বাড়িতে একলা একলা…
খুব ভালো লাগছে।
আমি তোমাকে নিয়ে আসব?
কেন টোকিও থেকে আবার নতুন কিমানো এনেছেন নাকি?
আর নয়। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার নামিয়ে রাখল মণিকা।
টেলিফোন রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না; দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না সেই স্মৃতি। সেই কয়েকটি মুহূর্তের বিন্দু বিন্দু অনুভবের টুকরো টুকরো স্মৃতি। অন্যায় হলেও অবিস্মরণীয়। রিসিভার নামিয়ে রাখলেই কি সেসব ভুলা যায়!
কত প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন আসে মনে। সে কথা সবাই জানে, যার সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা, লজ্জা-ঘৃণার অনুভূতি আর পাঁচজনে ভাগ করে নেয়, তার জন্য বেশি চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু যে কথা যে কাহিনি, যে ইতিহাস বাইরের দুনিয়ার কেউ জানে না, যে আনন্দ বেদনার ভাগ অপরকে দেওয়া যায় না, তা যেন কিছুতেই ভুলা যায় না।
সন্ধ্যায় অন্ধকারটা একটু গাঢ় হলো। শূন্য বাড়িটায় নিঃসঙ্গ মণিকার মনও যেন অন্ধকারে ভরে গেল। চেয়ারে বসে টেবিলে পা দুটো তুলে দিয়ে হাতে পেন্সিল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই একবার নিজেকে দেখে। ভালো করে দেখে।
হঠাৎ বেল বেজে উঠল। চারটা নিশ্চয়ই বিড়ি খেয়ে ফিরে এসেছে। মণিকা উঠল না। চুপ করে বসে বসেই আরো ভালো করে নিজেকে দেখল। নিশ্বাসটা যেন একটু চঞ্চল, বুকের স্পন্দন যেন একটু বেশি জোরে শোনা যাচ্ছে।
আবার বেল বাজল। পর পর দুবার বাজল।
বেশ বিরক্ত হয়ে মণিকা উঠে গেল দরজা খুলতে।
ক্যাপ্টেন? ফিরে এসেছে। মণিকা থমকে দাঁড়ায়, চমকে ওঠে।
তুমি?
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েই ক্যাপ্টেন জবাব দেয়, সন্দেহ হচ্ছে নাকি?
ক্যাপ্টেন ভেতরে পা দিয়ে ওর ঠিক সামনে দাঁড়াতেই মণিকা যেন মাতাল হয়ে ওঠে। দুটো হাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, কি আশ্চর্য লোক বলতো তুমি।
ক্যাপ্টেন অবাক না হয়ে পারে না। এই সেই মণিকা? যার গাম্ভীর্য, যার সংযম, যার সংযত আচরণ দেখে সে এক ধাপ এগোতে পারত না, এই সেই মণিকা? হঠাৎ এমন কালবৈশাখীর মাতলামির নেশা চাপল কেন ওর মাথায়?
কেন বল তো?
দরজার মুখেই বড় বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুজনে। তবু হুঁশ নেই।
ক্যাপ্টেন হুঁশ ফিরে পায়। কি ব্যাপার? বাড়িতে কেউ নেই নাকি?
না।
কেউ না?
না।
সত্যি?
সত্যি।
চাকরটাও নেই?
না।
এবার ক্যাপ্টেন নিজেই দরজাটা বন্ধ করে মণিকাকে একটু কাছে টেনে নেয়। হাত দিয়ে মুখটা একটু তুলে ধরে।
কি হয়েছে?
মণিকা জবাব দেয় না, দিতে পারে না। সে কি বলতে পারে যে নেকড়ে বাঘটা তাকে একবার আক্রমণ করে পরাজিত করেছিল, যে একবার তার রক্তের স্বাদ পেয়েছে, যৌবনের উপবন উপভোগ করেছে, সে আশেপাশেই রয়েছে? একথা কি বলা যায়?
ক্যাপ্টেন ডান হাত দিয়ে মণিকার চিকন কোমরটা জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে উপরে উঠে যায়।
দূরের আকাশে মিট মিট করে তারা জ্বলছে, আশেপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠছে। মণিকার অন্ধকার ঘরে এবার জ্বলে উঠল দুটি হৃদয় প্রদীপ।
মণিকা যেন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতিতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। নদীর জলে যখন শূন্য কলসি ভরা হয়, তখন বগ বগ করে কত আওয়াজ, কত বুঁদ বুদ। যখন ভরে যায়? সব কলরব-কোলাহল স্তব্ধ হয়।
মণিকাও পূর্ণ মন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল ক্যাপ্টেনের পাশে।
আরও কয়েকটা অপ্রত্যাশিত সম্ভাবনার মুহূর্ত কেটে গেল।
অফিসার্স মেসে, ক্লাবে-হোটেলে, পার্টিতে-ডিনারে বা কখনও কখনও মানুষের ভিড় থেকে দূরে, বহু দূরে ক্যাপ্টেন অনেক মেয়ের দেখা পেয়েছে। দেখা পেয়েছে রাজভবনে, দুর্গাপুর স্টিল টাউনের রানিকুঠিতে, জলপাইগুড়ির সার্কিট হাউসে। দেখা পেয়েছে নানা বেশে, নানা রং-এ নানা পরিবেশে। কিন্তু স্তব্ধ পরিবেশে এমন আত্মসমর্পণের নেশায় মশগুল আর কাউকে দেখেনি।
একি সেই মণিকা? নাকি অপারেশন থিয়েটারের পেসেন্ট? ক্লোরোফর্ম করা হয়ে গেছে! সার্জেন যা খুশি…
ক্যাপ্টেন ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয় মণিকাকে। একটু বেশি কাছে। এমন করে আর কোনোদিন কাছে টানেনি। অন্যদিন হলে মণিকা হয়তো লজ্জায় মুখে কিছু বলত না তবে হাতটা নিশ্চয়ই সরিয়ে দিত। সরিয়ে দেবে না কেন? এত অর্থপূর্ণ জড়িয়ে ধরাকে এখনই মেনে নেবে কেন? আজ কিছু বললে না।
মণিকা?
কথা বলে না।
আজ তোমার কি হয়েছে বলতো?
আরো কয়েকবার পীড়াপীড়ির পর ছোট্ট জবাব দেয় মণিকা, শরীরটা ভালো নেই।
শরীর না মন?
জবাব আসে না এ প্রশ্নের।
তোমার শরীর খারাপ লাগছে?
না।
দেখে মনে হচ্ছে তুমি বড় ক্লান্ত।
মণিকা আবার চুপ করে যায়।
দুটো বালিশ টেনে ক্যাপ্টেন এবার মণিকাকে শুইয়ে দেয়। একটু হাত বুলিয়ে দেয় ওর মাথায়, মুখে।
মণিকা এবার ক্যাপ্টেনের হাতটা নেয় দুহাতের মধ্যে।
ক-দিন ধরেই তোমার কথা ভাবছি।
ক্যাপ্টেন খুশি হয়। কেন?