দুজনে দুকাপ চা খেয়ে চলে যেত শহরে, দেরাদুনে। রাজপুর রোডের ধারে কোনো একটা সিনেমা হলে ঢুকে পড়ত। কোনো কোনো দিন আবার সিনেমা হলে না ঢুকে ওই রাজপুর। রোড ধরেই আরো এগিয়ে যেত সাইকেলে চড়ে। শহরের ধারে পাহাড়ের কোলে বসে গল্প করত ঘন্টার পর ঘন্টা।
কেন ছুটিতে? কত কি করেছে দুজনে।
একবার ছুটি থেকে ফিরে ক্যাডেট কমল রায় মেসে এসে আর দেখতে পেল না জেনকিন্সকে। একদিন, দুদিন, তিনদিন পর হয়ে গেল। জেনকিন্সের পাত্তা নেই। কমলের মনটা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কয়েকদিন পরে অফিসে খবর নিয়ে জানল, মার্ডার করার দায়ে জেনকিন্স জেল হাজতে।
জেনকিল মার্ডার করেছে? অনেক চিন্তা ভাবনা করার পরও বিশ্বাস করতে পারল না। মাস কয়েক পরে হঠাৎ জেনকিন্সের ছোট্ট একটা চিটি পেল কমল।
…প্রেসিডেন্সি জেলের একটা সেল থেকে এই চিঠি লিখছি। দুনিয়ার সব চাইতে জঘন্যতম কাজ-মানুষ হত্যা আমি করেছি। কাব্যে, সাহিত্যে, শিল্পীর সৃষ্টিতে যে মাকে মহীয়সীরূপে দেখিয়েছে, যার গর্ভে জন্মে আমি ধন্য হয়েছি সেই তিনি পয়সার জন্য এত নীচে নামতে পারবেন, ভাবতে পারিনি। হাজার হোক নিজের মা। তাইতো রিভলভারটা তার দিকে তুলতে পারলাম, যে পিশাচ মাকে কলুষিত করেছিল, সেই তাকেই একটা গুলিতে শেষ করে দিলাম।…
আর কেউ না হোক, অন্তত তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।…
চমকে উঠেছিল ক্যাডেট কমল রায়। এই দুনিয়ায় এও হয়? এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায় সেদিনের কথা ভেবে আপন মনে হাসে। হাসবে না? মানুষের নিত্য নতুন চেহারা দেখতে দেখতে আজ সে মশগুল হয়ে গেছে। মিঃ সর্বাধিকারীর কথা না হয় বাদই দিল। কেন মিস বিশ্বাস? এই বয়েসে কি কাণ্ডটাই করল?
০২. মিস বিশ্বাসের কথা
মিস বিশ্বাসের কথা মনে হতেই ক্যাপ্টেন রায় হাসেন। হাসবেন না? সে তো এক মহাভারত! শেষ নেই তার কীর্তির, তার কাহিনির।
অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেট কেস থেকে অশোকস্তম্ভ আঁকা বিলেতী কোম্পানির একটা সিগারেট বের করলেন। টেবিলের ওপাশ থেকে লাইটারটা টেনে নিয়ে জ্বালতে গিয়ে কি যেন ভাবলেন।
কি আর ভাববেন?
ভাবছিলেন ডায়মণ্ডহারবার রোডের সরকার বাড়ির কথা। আদিনাথ সরকার, দিবানাথ সরকার ও সতীনাথ সরকার। তিন ভাই। তিন রত্ন? মণিমাণিক্য হীরা-জহরত বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের উর্বর জমিতে বিনা কসরতে ধান, পাট আর বিপ্লবী হতে পারে কিন্তু শিল্পপতি হওয়া দুর্লভ ব্যাপার। রাজস্থানের মরুভূমির প্রাণহীন, হৃদয়হীন বীজ, বাংলাদেশের জল হাওয়ায় শুধু বড়বাজারে নয় সর্বত্রই পল্লবিত হয় কিন্তু বাংলার বীজ ডালহৌসী-ক্লাইভ স্ট্রিটে পুঁতলেও কৌনোদিন ফল ধরে না। বিধাতার এই নির্মম রসিকতাকে উপেক্ষা করে যে মুষ্টিমেয় কটি বাঙালি পরিবার লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করতে পেরেছেন, সরকার বাড়ি তার অন্যতম।
আদিনাথ তো সাক্ষাৎ দেবতা। চেহারাটা দেখলেই ভক্তি আসে। সেকালের প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। ছাত্রজীবন শেষ করে পিতৃপদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রথমে ক্যানিং স্ট্রিট ও কলেজ স্ট্রিট। পরে মিশন রো। আরো পরে ব্রেবোর্ন রোড। হাজার। লাখ। কোটি। না জানি কত কোটি।
এখন বয়েস হয়েছে। টাকা পয়সা স্পর্শ করলে রামকৃষ্ণের মতো জ্বালা অনুভব না করলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। এখন সাধুসঙ্গ আর সৎ কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। পরলোকগতা স্ত্রী নীহারিকা দেবীর নামে কলকাতার উপকণ্ঠে নীহারিকা মাতৃসেবাসদনে নিত্য কত নারীর সেবা হচ্ছে। কত সহায় সম্বলহীনার শিশু পৃথিবীর প্রথম আলো দেখছে এই মাতৃসেবাসদনে।
সিগারেট জ্বালতে গিয়ে লাইটারটা হাতে নিয়ে এত কথা মনে পড়ার কথা নয়। কিন্তু কি করবে ক্যাপ্টেন রায়? হিজ এসেলেন্সী জগৎপতি বাজপেয়ী পাঁচ পাঁচ বছরের দুটি টার্মে বাংলাদেশের গভর্নর থাকায় এই সরকার বাড়ির সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ না হয়ে পারেনি।
ঠাকুরপুকুর ছাড়িয়ে বেশ কিছু এগিয়ে গেলে নীহারিকা মাতৃসেবাসদন। মেটারনিটি আর জেনারেল ওয়ার্ড আগের থেকেই ছিল কিন্তু সার্জিক্যাল ওয়ার্ড না থাকায় বড়ই অসুবিধা হচ্ছিল। চটপট অপারেশন করলে যাদের বাঁচান যেত তারাও পি-জি-তে যাবার পথে অ্যাম্বুলেন্স বা ট্যাক্সিতেই প্রাণ হারাতেন। আদিনাথবাবু মনে মনে বড় কষ্ট পেতেন। বছরের পর বছর নিঃশব্দে এই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। ভাবতেন, হয়তো আশেপাশে সরকারি হাসপাতালে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও কিছু হল না। রাইটার্স বিল্ডিং-এ দরখাস্ত পাঠান হল নানা মহল থেকে। না, তবু অচলায়তন নড়ল না।
এম-এল-এ বিনোদবাবু যখন এসে বললেন, সামনের বছরের বাজেটে ইনকুড করার জন্য কত অনুরোধ করলাম কিন্তু তাও সম্ভব হল না।
অচঞ্চল আদিনাথবাবু বললেন, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। মার যদি ইচ্ছা থাকে, তবে…
মাস ছয়েক পরে বিনোদবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আদিনাথবাবু এলেন রাজভবনে। ক্যাপ্টেন রায় সেদিন ডিউটিতে ছিলেন না। কিন্তু যেদিন সকালে নীহারিকা মাতৃ সেবাসদনের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ও অপারেশন থিয়েটারের ওপেনিং করতে গভর্নর গিয়েছিলেন, ক্যাপ্টেন রায় সেদিন ডিউটিতে ছিলেন।
সরকার বাড়ির সঙ্গে সেই তার প্রথম পরিচয়।