বিছানা ছেড়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে দেখল। সেদিন কিমানো পরাতে গিয়ে বলাইদা যে হঠাৎ পাগলামি করেছিল, আমার জীবন বসন্তের যে মধু…
না, না। আর ভাবতে চায় না মণিকা। কিন্তু ভয় করে। ধরা পড়বে না তো ক্যাপ্টেনের কাছে? স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হবে না তো?
সেই একটা দিনের স্মৃতি যখন মনে পড়ে, মণিকা শিউরে ওঠে। একটা দিন কোথায়? কয়েক ঘণ্টা! না তাও না। বড় জোর আধ ঘণ্টা। বরং পনের-বিশ কি পঁচিশ মিনিটই হবে। কিন্তু ওই কয়েকটা মিনিটেই জীবনের বনিয়াদ ধরে টান পড়েছিল। ঝড় বৃষ্টি বা সাইক্লোন নয়। ভূমিকম্প। পলকেই সবকিছু। দীর্ঘদিনের সাধনায়, অনন্ত পরিশ্রম করে যে সৌধ সৃষ্টি হয়, প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা যাকে স্পর্শ করতে পারে না, সেই তারও জীবনসঙ্কট উপস্থিত হয় ওই কয়েকটি মুহূর্তের ভূমিকম্পে।
সেদিনের ওই কয়েকটা মিনিটেই মণিকার জীবন নাট্যে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করল। এতে অভিনবত্ব কিছু নেই। এই পৃথিবীতে কোটি-কোটি বলাইদা ছড়িয়ে আছে। শিক্ষাদীক্ষা আচার আদর্শের পিছনে লুকিয়ে থাকে ইন্দ্রিয়। লোলুপ ইন্দ্রিয়। শিকারি ইন্দ্রিয়। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ওদের ওই লোলুপ ইন্দ্রিয়ের কাছে বলিদান যাচ্ছে কত মণিকার যক্ষের ধন। কোনো না কোনো বলাইয়ের হাতে তিলে তিলে সঞ্চিত যক্ষের ধন হারাতেই হয়। কিন্তু তার পরিবেশ আছে, মানসিক প্রস্তুতি আছে। যেখানে সে প্রস্তুতি নেই, সহজ সরল স্বাভাবিক পরিবেশ নেই, নেই সামাজিক স্বীকৃতি, সেখানেই দ্বিধা, সঙ্কোচ। মনের মধ্যে কত প্রশ্ন আসে যায়। যে চাওয়া, যে। পাওয়ার মধ্যে পরিপূর্ণ তার সৌন্দর্য নেই, সৃষ্টির আনন্দ নেই, যে স্ফুলিঙ্গ কল্যাণ দীপশিখা জ্বালায় না কিন্তু সারা জীবন মনকে তিলে তিলে দগ্ধ করে-মণিকা তা ভুলবে কেমন করে?
তাছাড়া বলাইদা কেমন শঠতা করে, চতুরতার সঙ্গে…
মণিকা রাগে জ্বলে ওঠে। না, কিছুতেই ওর ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যাবে না। বাবা-মা বললেও না। কোনো অছিলায় এড়িয়ে যাবে।
মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন নিঃসঙ্গ বোধ করে মণিকা। নাকি অসহায়! ওই মুহূর্তের জন্যই।
ক্যাপ্টেনের নির্ভর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের কথা মনে পড়ে। কতদিন ঘুরে বেড়িয়েছে ওর সঙ্গে। কত জায়গায়। কত বিচিত্র পরিবেশে। সকাল, সন্ধ্যায়। কখনও বা রাত্রে। কলকাতায়, উপকণ্ঠে। গ্র্যান্ড, গ্রেট ইস্টার্ন, ব্লফক্স, বা ক্যালকাটা ক্লাবে, ফোর্ট উইলিয়ামের অফিসার্স মেসে। লাঞ্চ, ডিনার ককটেল ক্যাবারেতেও। রাজভবনের ঘরে একা একা কাটিয়েছে সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা। কিন্তু কই, কোনো দিনের জন্যও বলাইয়ের মতো কোনো সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ওর যৌবন দুর্গ আক্রমণ করেনি? দখল করতে চায়নি! বড় জোর হাতটা চেপে ধরে মুখের কাছে এগিয়ে এনে ফিস ফিস করে বলেছে, এই ধূসর জীবনের গোধূলিতে আর কতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব?
নয়তো বলত, জানত, Waiting is the hardest time of all.
মণিকা বলত, Everything comes to those who can wait.
ক্যাপ্টেন হাতটা আর একটু চেপে ধরে বলেছে, সেই ছবি দোলা খায় রক্তের হিল্লোলে, সে ছবি মিশে যায় নিঝর-কল্লোলে…
সুরের দোলা মণিকার মনেও ঝঙ্কার দেয়। হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটুর পর মুখ রেখে একটু হাসে। একবার দেখে নেয় ক্যাপ্টেনকে। চোখের কোণায় স্বপ্নের বিদ্যুৎ-স্পর্শ।
ক্যাপ্টেন বলে, উত্তর দিতে পারছ না তো?
সত্যি উত্তর চাও?
নিশ্চয়ই।
মণিকা একটু ভাবে। একটু ডুব দেয়। হয়তো একটু অনুভব করে তবে শোন—
ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই,
যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই।
কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে
প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে।
আরো কত কি হতো! কিন্তু ও তো কোনোদিন কোনো অন্যায় দাবি করেনি।
অন্যায়?
মাঝে মাঝেই মনে হতো ক্যাপ্টেন অপূর্ণতার বেদনায় বড়ই পীড়িত। মণিকারই খারাপ। লাগত। কখনও কখনও মনে হতো, সব কিছু উজার করে ক্যাপ্টেনকে সুখী করে, পরিপূর্ণ করে, পরিতৃপ্ত করে।
পারত না। মনের ইচ্ছা মনেই থাকত। প্রকাশ করত না। তবুও দ্বন্দ্ব দেখা দিত মনের মধ্যে। কেন নিজের দাবিতে এগিয়ে আসতে পারে না? যেদিন সে দাবি নিয়ে এগিয়ে আসবে; আমাকে আমন্ত্রণ জানাবে, আমাকে প্রাণের মধ্যে টেনে নেবে, সেদিন তো আমি বাধা দেব না, আপত্তি করব না। বরং ওর ঐশ্বর্যে নিজেকেও…
দূরের শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে আরো কত কি ভাবে মণিকা।
এক্ষুনি যদি ওকে পেতাম তাহলে হয়তো আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতাম না। বাবা-মাকে বলতাম…
সত্যই কি বলতে পারতাম?
কেন বলব না? অন্যায় কিছু নয়।
সম্ভব হলে আজই সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে লাল টকটকে বেনারসি পরে যেতাম ওই ব্রিলিয়ান্ট বলাইয়ের…
বহু অসম্ভবের মতো এটাও সম্ভব হলো না মণিকার। তবে নিজে গেল না। বাবা-মাকে বললে শরীরটা খারাপ।
ডক্টর ব্যানার্জি দু-একবার বললেন। তুই বাড়িতে শুয়ে থাকবি আর আমরা নেমন্তন্ন খেতে যাব?
তাতে কি হয়েছে? আমি কি কোনোদিন নেমন্তন্ন খাইনি?
কিন্তু ও তোর কথা বার বার করে বলেছিল।
এ-কথার কি জবাব দেবে মণিকা। মনে মনে ভাবল, বার বার করে, বলবে না? কিমানো পরাবার স্মৃতি কি ভুলতে পারে? তাছাড়া হয়তো নতুন করে…।
মা বললেন, থাক থাক। ও বরং নাই গেল। আজ সকাল থেকেই ওর শরীরটা ঠিক নেই।