গাড়ি বালি ব্রিজে। গঙ্গার হাওয়ায় চুলগুলো উড়ে উড়ে মণিকার মুখে পড়ছে। আঁচলটাও উড়ছে। বলাই একবার দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে দেখে নেয়।
শেষ পর্যন্ত উঁচুড়া ঘুরেই এলো। তুবও বেশ ভালো লাগল। কলেজ-হোস্টেলের নিয়মতন্ত্রের বাইরে এই একদিনের মুক্তির আনন্দ যেন ভোলা যায় না।
বলাই সিঙ্গাপুর বদলি হবার পরও মনে পড়ত। মাঝে মাঝে। কখনও কখনও। কলেজের ঘণ্টা, হোস্টেলের ঘণ্টা, আর ওই উঁচু লোহার গেটটার মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠলেই মনে পড়ত।
উপরের ঘরে চুপ করে বসে বসে সেসব কথা মনে পড়ছিল মণিকার। হাঁটুর পর কনুই রেখে হাতের পর মুখ দিয়ে কিছুটা উদাস হয়ে ভাবছিল।
রাতের স্বপ্ন চোখে নিয়েই ঘুম থেকে উঠেছিল। বেশ লাগছিল। আলাপের পর রাগ শুরু হবার মুখেই সেতার থেমে গেলে যেমন বিরক্ত লাগে, ঠিক তেমনি অস্বস্তিবোধ করছিল মনে মনে।
শুধু চুঁচুড়া ঘুরেই যদি সব শেষ হতো তাহলে হয়তো এমন বিচ্ছিরি লাগত না। বি-এ পরীক্ষা দিয়ে রেঙ্গুনে যাবার পর যদি…
ভারতেও খারাপ লাগে মণিকার। বার বার সরিয়ে দেয় টুকরো টুকরো চিন্তার মেঘগুলো। আকাশটা একটু পরিষ্কার হলেই দেখতে পায় ক্যাপ্টেনকে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার কোথা দিয়ে যে ওই স্মৃতি বোঝাই মেঘগুলো হাজির হয় তা মণিকা বুঝতে পারে না।
তাছাড়া ভীষণ অস্বস্তিবোধ করছে। ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মনে মনে অনেকদূর এগিয়েছে। ভবিষ্যতের ছবিটাও মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ঠিক এমন সময় মনটা বিক্ষিপ্ত হবে, ভাবতে পারেনি।
উপর থেকে নীচে নেমে এলো। এঘর-ওঘর ঘোরাঘুরি করল। খবরের কাগজটা একবার হাতে তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়েই নামিয়ে রাখল। এমন বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কাগজ পড়া যায়?
সিঁড়ি দিয়ে দু-এক ধাপ উপরে উঠতেই মা পিছন থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে তুই বাথরুমে-টাথরুমে যাবি না? কখন জলখাবার খাবি?
মণিকা পিছন ফিরে বলল, শরীরটা যেন কেমন করছে। এক্ষুনি কিছু খাব না।
কিছু ঔষধপত্র খাবি?
না, না। একটু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।
উপরে নিজের ঘরে সত্যি মণিকা শুয়ে পড়ল। এই সকালবেলাতেই দিনের শেষের ক্লান্তি আর অবসাদ যেন ওকে ঘিরে ধরল।
…রেঙ্গুন। ইউনিভার্সিটির পাশেই ইউনিভার্সিটি এভিনিউ ও প্রোম রোডের প্রায় কোণাতেই ডক্টর ব্যানার্জির কোয়ার্টার। কলকাতা থেকে এসে ভীষণ ভালো লাগল এই কোয়ার্টারকে। চার পাঁচখানি বড় বড় ঘর। তাছাড়া প্যাগোডার মতো একটা ছোট্ট আউট হাউস ধরনের আরেকটা ঘর সামনের লনের এক কোণায়। পিছনের দিকটা আরও চমৎকার। গাছপালা লতাপাতা। একটা ছোট্ট বটানিক।
বাড়িতে ঢুকে এক মিনিট বসল না, মুখে একটু জল পর্যন্ত দিল না। প্রায় ঘণ্টখানেক ধরে শুধু বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল!
মা, তুমি যে এখানে এসে একেবারে সিজনড় ইন্টিরিয়র ডেকরেটর হয়ে গেছ দেখছি।
মিসেস ব্যানার্জি মুচকি হাসেন। আমি কিছু করিনি। প্রায় সারা বাড়িটাই বলাই সাজিয়ে দিয়েছে।
প্রথমটা শুনে চমকে উঠেছিল মণিকা। বলাইদা রেঙ্গুনে?
উপরের ঘরে চুপটি করে শুয়ে শুয়ে মনে করছিল সেসব স্মৃতি। প্রথম কিছুদিনের মিষ্টি স্মৃতি। হৈ হৈ করার কথা! উঃ! কি ঘুরেই বেড়িয়েছে। সারা শহরটাকে চষে খেয়েছে দুজনে। তারপর গেছে রয়্যাল লেকের ওরিয়েন্ট ক্লাবে।
সাপুড়ের মতো শুধু বাঁশি বাজিয়েই চলেছিল বলাই। আর যেন কোনো অভিসন্ধি ছিল না ওর। ছেলেদের মতো সারা পুকুর জুড়ে জাল ফেলেছে, বুঝতে দেয়নি শিকারের পরিকল্পনা। অনেক পরে ধীরে ধীরে জাল গুটিয়ে এনেছে। সাপুড়ের মিষ্টি বাঁশি আর শোনা যাচ্ছিল না। থেমে গেছে। শিকার যে হাতের মুঠোয়। তখন আর বেরুবার পথ নেই, পালাবার উপায় নেই।
সকালেই বেরিয়েছে মণিকাকে পেণ্ড দেখিয়ে আনবে বলে। বিকেলেই ফিরবে! পোম রোড দিয়ে এসে মন্টগুমারি স্ট্রিট পার হয়ে বলাই নিজের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল।
চল একটু নামি।
কেন?
একটু কিছু খেয়ে নেব!
সে কি? আপনি ব্রেকফাস্ট করেননি?
না।
মণিকা একটু রাগারাগি করলেও শেষ পর্যন্ত উপরে গেল।
অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করল।
মণিকাকে ভিতরের স্টাডিতে নিয়ে বলল, একটু বসো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিতর থেকে কতকগুলো বিরাট বিরাট প্যাকেট নিয়ে এলো। এই নাও এগুলো তোমার।
তার মানে?
আবার তর্ক। আবার কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত খুলল।
কপালে হাত ঠেকিয়ে মণিকা বললে, মাই গড! করেছেন কি?
আবার তর্ক করছ? এই জাপানিজ সিল্কের শাড়িটা পরবে?
না, না। এখন নতুন শাড়ি পরব কেন?
আবার কেন? সব কেন-র কি কারণ থাকে?
হাউ ডু ইউ লাইক দিস কিমানো?
মণিকা আর জবাব দেয় না। শুধু বিস্ময়ে চেয়ে থাকে বলাই-এর দিকে।
একটা অনুরোধ রাখবে?
বলুন।
আগে বলো রাখবে কিনা?
পারলে নিশ্চয়ই রাখব।
না পারার মতো কিছু বলব না।
তাহলে নিশ্চয় রাখব।
কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমাকে ছুঁয়ে বলল।
মণিকা হেসে ফেলে। কি ছেলেমানুষি করছেন।
মণিকা ওর গায়ে হাত দিতেই বলাই ওই হাত ধরে টেনে নিল, লক্ষ্মীটি এই কিমানোটা পর।
অবাক বিস্ময়ে হাসিতে-খুশিতে ভ্রু-দুটো টেনে উপরে তুলে মণিকা বলল, এই কিমানোটা পরব।
হ্যাঁ।
আমি তো কিমানো পরতে জানি না।
উপরের ঘরে শুয়ে শুয়ে সব ভাবছিল। পাশ ফিরে শুয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে মনে মনে কত প্রশ্ন আসে। কত কথা আসে। কত ভাবনা আসে।