তুই মা হলে তুইও বুঝবি।
মণিকা আর দাঁড়ায় না মা-র সামনে, চলে যায় বাবার স্টাডিতে।
তুমি আমাকে ডাকছিলে বাবা?
হাতের বইটা নামিয়ে রেখে ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, না ডাকছিলাম না। তবে আজ তুই চা দিতে এলি না দেখে খোঁজ করছিলাম।
কাল শুতে শুতে একটু রাত হয়েছিল বলে আজ উঠতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
মণিকা বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ওর বাবা ডাক দিলেন, হ্যারে তোর মনে আছে তো আজ বলাই-এর ওখানে যেতে হবে?
মাথাটা ঘুরিয়ে পিছন ফিরতে গিয়ে আলতো করে বাঁধা খোঁপাটা খুলে গেল। মুখে কিছু বলল না, ভ্রু কুঁচকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
কিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলি যে? ভুলে গিয়েছিলি বুঝি?
হ্যাঁ, ঠিক মনে ছিল না।
মণিকা চলে যায়। একটু দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে আস্তে আস্তে ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যায়।
দ্বিধা হবে না?
ডক্টর ব্যানার্জি বলাই বলতে অজ্ঞান। একে বাল্যবন্ধুর ছোট ভাই, তারপর নিজের প্রিয় ছাত্র। সেবার হাই ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিল একমাত্র ওই। তাছাড়া সে কৃতী, সে সাকসেসফুল। ডক্টর ব্যানার্জির দূর্বলতা থাকার কারণ আছে বৈকি!
নিজের ঘরে চুপ করে বসে থাকতে থাকতেই মণিকা ভাবে, বাবার জন্য মা-ও বলাই-বলাই করে অস্থির। তাছাড়া মাসিমা-মাসিমা করে ন্যাকামি করে যে!
একটা ফ্রেঞ্চ কনস্ট্রাকশন ফার্মের রিজিওন্যাল রিপ্রেজেনটেটিভকে নিয়ে এত মাতামাতি করার কি আছে? না হয় হাজার হাজার টাকা রোজগারই করেন! ঘন ঘন বিদেশ গেলেই কি মাথা কিনে নিয়েছে?
সব কথা মা-বাবাকে বলা যায় না। মণিকাও বলেনি কিন্তু তাই বলে তো সে কথা ভুলে যায়নি।
কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে। বাবা-মা রেঙ্গুনে। হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সে জামা-কাপড়, খাবার-দাবারের কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে কৃতী বলাই হাজির হলো মণিকার হোস্টেলে। মণিকা প্রথমে চিনতে পারেনি।
বলাই বুঝতে পারল। কি চিনতে পারছো?
একটু লজ্জিত হয়ে মণিকা বলল, ঠিক মনে পড়ছে না।
আমি বলাইদা। তোমার বাবার ছাত্র। এবার মনে পড়েছে?
মনে পড়বে না? বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু কানাইবাবু। ওর রাঙা জেঠু। একে তার ছোট ভাই, তারপর বাবার প্রিয় ছাত্র।
খুশিতে মণিকা হাসে। আপনি বলাইদা?
হ্যাঁ।
বারান্দায় দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল।
চলুন ভিজিটার্স রুমে গিয়ে বসি।
উত্তর দেবার আগেই হাতের ঘড়িটা দেখল। ওদিকে তাকিয়ে ইসরায় ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল।
না, আজ আর বসব না। আমি আজকাল প্রায়ই রেঙ্গুনে যাতায়াত করি আর সময় পেলেই তোমার বাবার কাছে চলে যাই। মাসিমা এগুলো তোমার জন্য পাঠিয়েছেন…।
একটু তো বসবেন?
বলাই আদর করে মণিকার গালে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, না, না আজ আর বসব না।
কোটের পকেটে হাত দিয়ে দুটো চিঠি বের করে মণিকার হাতে দিল, এই চিঠি দুটো রাখো। একটা তোমার আরেকটা তোমার হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের।
এক কাপ চাও খাবেন না?
এবার স্নেহের শাসন। তুমি ছোট হয়ে আমাকে কি খাওয়াবে, আমি তোমাকে খাওয়াব।
সেদিন বলাইদা আর অপেক্ষা করল না। চলে গেল।
বলাইয়ের গাড়িটা গেট দিয়ে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওই দিকেই চেয়ে রইল মণিকা। বেশ লাগল। হাসি-খুশি-প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা একটা সার্থক মানুষ মনে হলো বলাইদাকে।
ডক্টর ব্যানার্জি হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জানিয়েছিলেন যে আমার বাল্যবন্ধু ও মণিকার লোক্যাল গার্ডিয়ান প্রফেসর কানাই সরকারের অনুপস্থিতিতে তার ভাই ও আমার ছাত্র বলাই সরকার মণিকাকে দেখাশুনা করবে।
রাঙা জেই তখন প্রায়ই কলকাতার বাইরে যেতেন। ছোটখাটো নানা কারণে মণিকার বেশ অসুবিধাই হতো। দু-একদিনের ছুটি পেলেও রাঙা জেঠুর চিঠির অভাবে চুঁচুড়ায় ছোট মাসির কাছে যেতে পারত না। তাইতো বাবার চিঠিটা পেয়ে মণিকা খুশি হয়েছিল।
বলাই মাসে দু-একদিন কয়েক মিনিটের জন্য মণিকাকে দেখে যেত। সব সময়ই কিছু না কিছু প্রেজেন্টেশন, খাবার-দাবার নিয়ে আসত। কদাচিৎ কখনও সময় থাকলে একটু আধটু গল্পগুজব করত দুজনে। কখনও কখনও আরো দুচারজন মেয়ে ঘিরে বসত, গল্প করত।
বলাই ব্যাংককে বদলি হবার আগে মণিকা বলেছিল, আপনি চলে যাবার আগে আমাকে একবার উঁচুড়া ঘুরিয়ে দেবেন।
একটা ছুটির দিনে সকালে বলাই নিজেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো মণিকার হোস্টেলে। একদিনের ছুটিতে মণিকা চললো মাসির বাড়ি। বলাইদার গাড়িতে চড়ে চুঁচুড়া যেতে মণিকার সে কি আনন্দ!
ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে যাবার সময় বলাই জিজ্ঞাসা করল, সোজা মাসির বাড়িই যাবে?
কেন আপনি অন্য কোথাও যাবেন?
স্টিয়ারিং ডান হাতে ধরে বাঁ হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিতে নিতে জবাব দেয় বলাই, তুমি চাও তো খানিকটা ঘুরে আসতে পারি।
ছুটির দিনে এমন মুক্তির আনন্দের আমন্ত্রণ পেয়ে মণিকা মনে মনে চঞ্চল হয়, উত্তেজিত হয়। অথচ…
কোথায় যেতে চান?
আমি তো ফুরসৎ পেলেই হাজারিবাগ চলে যাই।
হাজারিবাগ?
সিঁথির মোড় ছাড়িয়ে টবিন রোডের মোড় পার হলো।
হাজারিবাগ বলে চমকে ওঠার কি আছে? দরকার হলে একদিনেই ঘুরে আসা যায়।
একদিনেই?
নিশ্চয়ই।
ডানলপ ব্রিজের কাছে বলাই স্টিয়ারিং ঘোরাল। ট্রেন লাইন ধরে গাড়ি চললো দক্ষিণেশ্বর-বালি ব্রিজের দিকে।
একবার মনে হলো ঘুরেই আসে হাজারিবাগ। বেশ মজা হবে। আবার ভাবে, না, না। একলা একলা বলাইদার সঙ্গে যাওয়া কি ঠিক হবে?