মণিকা তিড়িং করে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তোমার মতো অসভ্য আর্মি অফিসারকে বাংলাদেশের মেয়ে বিয়ে করবে?
মেয়েরা অনেক কথাই এড়িয়ে যায়, স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করে কিন্তু তাই বলে মনে মনে অনুভব করে না, তা নয়। বাড়ি ফিরে গিয়েও বার বার মনে পড়েছিল ক্যাপ্টেনের কথা। মনে মনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করেছিল।
কলেজে বোজ অর্পিতার পাশে বসত কিন্তু যেদিন অর্পিতা না আসত সেদিন লিলির পাশে ওকে বসতে হতো, সেদিন কি বিশ্রী লাগত! কেন অধ্যাপক মঙের ছেলে? জান সিস্টার, বাড়িতে ঢুকেই আমি বুঝতে পারি তুমি আছ কি নেই।
মণিকা জানতে চাইত, কেমন করে?
মেয়েদের একটু ফ্লেবার আছে। মা-মারা যাবার পর সে গন্ধ আর পেতাম না। কিন্তু তুমি আসা-যাওয়া শুরু করার পর আবার যেন সেই হারিয়ে যাওয়া গন্ধটা খুঁজে পাচ্ছি।
তবে কি ক্যাপ্টেনের কথাই ঠিক? উপরের ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দূরের আকাশ দেখতে দেখতে কতবার ভাবছিল এইসব কথা। পাশ ফিরল। ও পাশের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। নিজের সৌরভে যেন নিজেই মাতাল হলো।
শুধু সে রাত্রে নয়, পরের কয়েকটা দিন নিজেকে নিয়েই মেতে রইল মণিকা। একটু একলা থাকলেই বড় বেশি নিজেকে দেখে। আপাদ-মস্তক দেখে। সর্বাঙ্গ দেখে। ওর লাবণ্য আছে? সৌরভ আছে?
আছে বৈকি! তা নইলে রাজভবনের আকর্ষণ তুচ্ছ করে ক্যাপ্টেন ছুটে আসে? হাই সোসাইটিতে একটু মর্যাদা পাবার জন্য কলকাতার কত মেয়ে এ-ডি-সি-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ক্যাপ্টেনের সঙ্গেও তো কত মেয়ের আলাপ। তবুও যখন ক্যাপ্টেন।
যেন আরো ভালো লাগে। বড় বেশি ভালো লাগে। কৃতজ্ঞতায় সারা মনটা ভরে যায়। বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। শুধু দেখতে? সামান্য একটু আদর করতে, একটু ভালোবাসতে। একটা গান শোনাতেও ইচ্ছে করছে।
গভর্নরের ওপর ভীষণ রাগ হয় মণিকার। এত ট্যুরে যাবার কোনো অর্থ হয়?-প্রতি মাসেই ট্যুর? যেন ক্যানভাসার, হেড অফিসে বেশিদিন থাকার হুকুম নেই। আচ্ছা ট্যুরে যাবে যাও, বক্তৃতা দিতে ভালো লাগে, দাও। তাই বলে সব সময় ক্যাপ্টেন রায়কে কেন? আর কি কোনো এ-ডি-সি নেই? আচ্ছা ও যদি ম্যারেড হতো? ছেলে-মেয়ে থাকত?
ছি, ছি। এমন করে একজন ইয়ংম্যানের লাইফ নষ্ট করে?
কলকাতা থেকে বর্ধমান-বাঁকুড়া-বীরভূম ঘুরে আসতে কতদিন লাগে? একদিন-দুদিনই তো যথেষ্ট! সাতদিন ধরে ঘুরে বেড়াবার কোনো অর্থ হয়? বর্ধমান পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করতে গভর্নরের যাবার কি দরকার? দেশে কি কোনো শিক্ষাব্রতী নেই? ভি-আই-পি চাই? ভালো কথা? ভাইস চ্যান্সেলার বা এডুকেশন মিনিস্টার তো আছেন। আরো বড় ভি-আই-পি? কেন চীফ মিনিস্টার? তার তো কাজ আছে, লাটসাহেবের মতো বক্তৃতা দিলেই চলবে না!
বর্ধমান পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবার তবু অর্থ হয় কিন্তু দুর্গাপুরে? লাটসাহেব কি ইঞ্জিনিয়ার? কলকারখানা দেখে উনি কি বুঝবেন? বুঝি আর না বুঝি তবুও যেতে হবে। লেকিন, মাগার করে বক্তৃতা দিতে দিতে ওয়ার্কারদের বলতে হবে দেশের ফয়দার জন্য আরো পরিশ্রম করতে হবে, আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। না জানি দেশের ফয়দার জন্য লাটসাহেব নিজে কত খাটছেন, কত ত্যাগ স্বীকার করছেন।
মেজাজ গরম হয়ে যায় মণিকার।
দুর্গাপুর থেকেও ফিরবেন না। রামপুরহাটে সিল্ক উইভার্স কোঅপারেটিভেও যেতে হবে। কেন? দুচার গজ সিল্কের কাপড় প্রেজেন্ট পাবেন বলে?
গভর্নরের ওপর যত রাগ হয়, ক্যাপ্টেনকে তত বেশি ভালো লাগে, তত বেশি কাছে পেতে ইচ্ছা করে।
জানালা দিয়ে দূরের আকাশের তারাগুলো দেখে। চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। তবুও মনে হয় ওরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
১১. রাতের তারা মিলিয়ে যায়
রাতের তারা মিলিয়ে যায় ভোরের আকাশে। কিন্তু রাতের স্বপ্ন? সে তো মিলিয়ে যায় না, হারিয়ে যায় না।
ঘুমের ঘোরেই মণিকা বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, হাতটা যেন কাকে খুঁজছে।
সারাদিনই খোঁজে। দৃষ্টিটা চলে যায় কতদূরে, এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায়ের কাছে।
মাকে ধরা দেয় না, কিন্তু নিজের কাছে? প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে সকালে, দুপুরে। সন্ধ্যায়, রাত্রে।
নীচের থেকে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পায়, হ্যাগো, খুকু কোথাও বেরিয়েছে নাকি?
শুয়ে শুয়েই টাইমপিসটা দেখে। ছি, ছি! এত বেলা পর্যন্ত শুয়ে আছে? তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। সারা রাত্তিরের স্বপ্ন বিধ্বস্ত চোখেমুখে একটু জল দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ঢিলেঢালা জামাকাপড় ঠিক করে নেয়। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চিরুনিটা তুলতে গিয়েই থমকে যায়।
…কদিন তোমার চিন্তায় চিন্তায় কি হয়েছি বলো তো! এবার ট্যুর থেকে ফিরে এসো। মজা দেখাব। তোমার জন্য কী বেইজ্জত হচ্ছি দেখছ? সাড়ে আটটা বাজে, এখনও আমি নীচে নামিনি।…
মাথার ওপর দিয়ে কোনোমতে চিরুনিটা বুলিয়ে নিয়ে দুহাত দিয়ে খোঁপা করে নেয়। হড়মুড় করে নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে।
সিঁড়ির মুখেই মা-র সঙ্গে দেখা। কাল কত রাত্তির অবধি নভেল টভেল পড়লি?
মণিকা মুহূর্তের জন্যে ভাবে। এই বিপদে লজ্জার হাত থেকে বাঁচবার জন্য এমন বুদ্ধি দেবার জন্য ভীষণ ভালো লাগে মা-কে। জড়িয়ে ধরে মা-কে। কি করে বুঝলে বলতো মা?