তবে।
তবে শোন।
তারপর ক্যাপ্টেন ধীরে ধীরে শুরু করেছিল, দুটি অপরূপা সুন্দরী বা যুবকের মধ্যেও পার্থক্য থাকে।
থাকেই তো।
কিসের পার্থক্য?
অনেক কিছুরই পার্থক্য থাকতে পারে।
পার্থক্য থাকে শুধু মাধুর্যের। দেহ আর মনের সমন্বয়ে জন্ম নেয় মাধুর্য। দুটি মেয়ে সুন্দরী হতে পারে কিন্তু দুজনের মাধুর্য কিছুতেই সমান হতে পারে না।
মণিকা তখনও তর্ক করে, তা তো হবেই।
কেন বলো তো?
মণিকা একটু থমকে দাঁড়ায়। দৃষ্টিটা সরিয়ে ঘুরিয়ে নেয় প্রায় নির্জন বোটানিকসের চারপাশ। হাঁটতে হাঁটতেই আনমনে দুটো একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। বাতাসে এক গোছা চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে। তাদের শাড়ির আঁচলটা খানিকটা বন্ধন মুক্ত করে উড়ে বেড়াচ্ছে।
ক্যাপ্টেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, সমুদ্র যেমন নদীকে আকর্ষণ করে ক্যাপ্টেনও মনে মনে তেমনি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করল।
মনে মনে বলল, মণিকা, যুগ যুগ আগে তুমিই বোধহয় হিমালয় দুহিতা পার্বতী ছিলে, তোমাকে দেখেই বোধহয় মহাদেবের…
মাথাটায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মুখের ওপর পড়া চুলগুলো সরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে মণিকা ফিরে বলল, কিছু বলছ?
ক্যাপ্টেন চমকে উঠে। না, না, কিছু বলছি না।
মনে হলো কি যেন বলছিলে।
কই না তো।
কিন্তু আমার যে মনে হলে তুমি বলছিলে।
ক্যাপ্টেন হাসে। তুমি কি বলতো?
হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছ?
তুমি কেমন করে বুঝলে আমি কিছু বলছিলাম।
মনে হলো যেন তোমার কথা শুনতে পেলাম।
ক্যাপ্টেন ভীষণ খুশি হলো কথাটা শুনে। আনন্দ খুশিতে সারা মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠল। মণিকার দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমার হাতটা দাও তো।
মণিকা কোনো প্রশ্ন করল না, প্রতিবাদ করল না। হাতটা বাড়িয়ে দিল।
ক্যাপ্টেন মণিকার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওকে একটু টানল। মণিকা হঠাৎ যেন বড় বেশি কাছে এলো।
ক্যাপ্টেন বলল, থ্যাঙ্কস, মেনি মেনি থ্যাঙ্কস মণিকা। আর আমার ভয় নেই।
মণিকার ইরানি ঠোঁটের কোণায় একটু তৃপ্তির হাসির রেখা ফুটে উঠল।
কি হলো?
কি হয়নি বলো?
ক্যাপ্টেনের হাতের মুঠোয় তখনও মণিকার হাত। তখনও দুজনে দুজনকে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে দেখছে। মণিকা একটি কথাও বলল না।
সত্যি, মনে মনে তোমাকে অনেক কথা বলেছিলাম। ভাবতে পারিনি তুমি জানতে পারবে, বুঝতে পারবে।
মণিকা দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। ক্যাপ্টেন প্রায় কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, আমার মনের কথাও যখন শুনতে পাও তখন আর আমার ভয় নেই, চিন্তা নেই।
ক্যাপ্টেন এবার আস্তে আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়ে আলতো করে ডান হাত দিয়ে ওকে একটু জড়িয়ে ধরে বলল, এবার তোমাকে সব কথা বলব। কিছুই লুকাব না।
আনত নয়নেই মণিকা প্রশ্ন করে, কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
শুধু রূপ নয়। রূপসী অনেকেই। শ্যামলীও। কিন্তু লাবণ্য? সবার থাকে না। গন্ধ-স্পর্শ-রূপলাবণ্য সব নিয়েই ভালো লাগা। ফুলের মতো মানুষেরও রূপ-লাবণ্যই শেষ কথা নয়। সৌরভই বড় কথা। মানুষেরও সৌরভ আছে, গন্ধ আছে। যে মেয়েদের সে সৌরভ নেই, মিষ্টি গন্ধ নেই, তাদের রূপ-লাবণ্যের কি মূল্য?
মণিকা কিছুতেই এসব বিশ্বাস করত না। তর্ক করত।
আমি কি গোলাপ যে আমার গন্ধ থাকবে, সৌরভ থাকবে?
প্রত্যেক মানুষেরই দেহের একটা গন্ধ আছে…
গন্ধ আছে?
নিশ্চয়ই আছে। প্রতিটি অঙ্গের একটা গন্ধ আছে। সব অঙ্গের গন্ধ মিলিয়েই দেশের গন্ধ…
আবার মাঝপথে বাধা দেয় মণিকা। কই আমি তো আমার দেহের কোনো গন্ধ পাই না।
পাবে না। তুমি তোমার দেহের গন্ধের সঙ্গে এত বেশি পরিচিত যে তা অনুভব করা সম্ভব নয়, কিন্তু তুমি তোমার মাকে কাছে একটু টেনে নিও, একটু জড়িয়ে ধরো, একটা অতি পরিচিত সুন্দর গন্ধ পাবে।
ক্যাপ্টেন একটু যেন সরে বসে। মুখটা মণিকার কানের কাছে নিয়ে একটু ফিস ফিস করে বলে, আমার দেহের গন্ধ পাচ্ছ!
মণিকা হাসতে হাসতেই ভ্রু কুঁচকে বলে, আঃ কি যা তা বলছ?
আর একদিন মধ্যমগ্রামের ফার্মে গিয়ে ক্যাপ্টেন আরো অনেক কথা বলেছিল।
একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে তুলে নিও। একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ পাবে…
ফার্মের মধ্যে ছোট্ট রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মণিকা জবাব দেয়, বাচ্চাদের গন্ধ থাকে বলে কি বুড়োদেরও থাকবে?
একশো বার থাকবে। দেহ, মন, বয়স ও চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গন্ধ বদলায়।
মণিকা তর্ক করে না কিন্তু ক্যাপ্টেনের যুক্তি মেনে নেয় বলেও মনে হয় না।
পরে ওই ছোট্ট কটেজের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে ক্যাপ্টেন বলেছিল, শ্যামলীর রূপ আছে, যৌবন আছে, কিন্তু লাবণ্য নেই। প্রথমদিন তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমার লাবণ্য আর সৌরভে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
মণিকা ডান হাতে চায়ের কাপ ধরে থাকল কিন্তু বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, কচু!
ক্যাপ্টেন মুচকি হেসেছিল। মনে মনে বলেছিল, কিভাবে তোমাকে এসব কথা বোঝাই বলতো? দেহমনের অপব্যবহার হলে রূপ থাকতে পারে কিন্তু লাবণ্য-সৌরভ নষ্ট হয়ে যাবেই।
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ওই মুচকি হাসতে হাসতেই বলেছিল, শ্যামলীর রূপ-যৌবনের চাইতে তোমার লাবণ্য-সৌরভ অনেক বেশি লোভনীয়।
আঃ কি অসভ্যতা করছ? বোঝাবার ক্ষমতা নেই, শুধু অসভ্যতা করতে পারো।
সামনের চেয়ারে বসে ক্যাপ্টেন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, বিয়ের আগে এর চাইতে বেশি বোঝান যায় না। বুঝলে?