আর দেরি করে না। একটা ট্যাক্সি কাছে আসতেই দুজনে হাত তুলল। থামাল। চড়ল।
বাড়ি পৌঁছেই মণিকা সামনের বাঁ দিকের ঘরে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মা, বাবা কোথায়?
ডক্টর চৌধুরি এসে তোর বাবাকে নিয়ে গেলেন।
ক্যাপ্টেনকে দেখে মিসেস ব্যানার্জি খুশি হলেন, এসো, এসো ভিতরের ঘরে চলো।
এবার মণিকার দিকে ফিরে বললেন, এতক্ষণ বেরিয়েছিস, একটা টেলিফোন তো করতে পারতিস।
মণিকার জবাব দেবার আগেই ক্যাপ্টেন বলল, আর বলবেন না মাসিমা। আমার কলিগ এ-ডি-সি ভাটিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে এমন গল্পের মশগুল হয়েছিলেন যে অনেক বলবার পরও উঠেছিলেন না!
হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে দূরের সোফায় ফেলে মণিকা বলল, আপনি কটা মার্ডার করেছেন। বলুন তো?
মার্ডার? চমকে ওঠে ক্যাপ্টেন।
এমন সুন্দর করে যে মিথ্যা কথা বলতে পারে, সে মার্ডার করে না?
ক্যাপ্টেন এবার মিসেস ব্যানার্জির সাহায্য সহানুভূতি চায়, দেখছেন মাসিমা, কি বলছেন?
আঃ। কি যা তা বলছিস? মণিকাকে শাসন করে ক্যাপ্টেনকে বললেন, যাও বাবা, তুমি ও ঘরে গিয়ে বসো আমি আসছি।
খালি হাতে আসবেন না। প্লেট ভর্তি করে কিছু আনবেন।
সবাই হাসে!
হাসি চাপতে চাপতেই মণিকা জানতে চায়, এমন করে বলতে আপনার লজ্জা করে না?
সরি! খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আবার লজ্জা কিসের?
মা-মাসির কাছে আবার লজ্জা কিসের?-বলেই মিসেস ব্যানার্জি চলে গেলেন।
মণিকা ক্যাপ্টেনকে নিয়ে ওপাশের বসার ঘরে এসে বলল, বসুন।
ক্যাপ্টেন বসল না। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো মণিকার কাছে। খুব কাছে। একেবারে মুখের কাছে, কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আপনাকেই প্রথম মার্ডার করব। রক্তটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খুব বেশি দিন ধৈর্য ধরতে পারব না।
ক্যাপ্টেন কোনোদিন এত কাছে, এত নিবিড় হয়ে এগিয়ে আসেনি। ক্যাপ্টেনের টানা বড় বড় নিশ্বাস মণিকার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। অপারেশন থিয়েটারের ক্লোরফর্মের মতো ক্যাপ্টেনের নিশ্বাস যেন মণিকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মুখে কিছু বলল না। শুধু অবাক-বিস্ময় মাখা মুগ্ধ নয়নে চাইল ক্যাপ্টেনের দিকে।
মণিকা চলে যাবার একটু পরেই মিসেস ব্যানার্জি এলেন।
টুকটাক কথাবার্তা বলার পর মিসেস ব্যানার্জি বললেন, একবার তোমার সঙ্গে এলাহাবাদ ঘুরে আসব।
নিশ্চয়ই। মা-বাবা ভীষণ খুশি হবেন।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে মণিকার কানে কথাটা গিয়েছিল।
তুমি ওর কথা বিশ্বাস কর মা?
কেন করব না?
গুরুজনেরা যখন কথা বলেন তখন মাঝখান থেকে হঠাৎ কোনো কথা না বলাই ভদ্রতা। ক্যাপ্টেন বেশ গম্ভীর হয়ে বলে।
মণিকা হাসি চাপতে পারে না, আপনিও আমার গুরুজন নাকি?
ক্যাপ্টেন আবার মিসেস ব্যানার্জির শরণাপন্ন হয়। আচ্ছা মাসিমা উনি আমার চাইতে বয়সে ছোট না?
তা তো বটেই।
আজকের থেকে আমি আর আপনাকে আপনি বলব না। ক্যাপ্টেন সাফ জানায় মণিকাকে। মিসেস ব্যানার্জির দিকে ফিরে বলল, ঠিক বলেছি না মাসিমা?
ও যখন তোমার চাইতে বয়সে ছোট তখন আর আপত্তি কি!
মণিকা প্রতিবাদ করতে যাবার আগেই ক্যাপ্টেন বলল, দেখ তো মণিকা, আমার চা-টা হলো কিনা।
মিসেস ব্যানার্জি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, না, না, আমিই যাচ্ছি।
মিসেস ব্যানার্জি চলে যাবার পরই মণিকা বলল, আজ আপনার কি হয়েছে বলুন তো?
ক্যাপ্টেন হঠাৎ মণিকার হাতটা চেপে ধরে বলে, তোমার কিছু হয়নি?
১০. এই রাজভবনে বসেই একদিন
এই রাজভবনে বসেই একদিন পলিটিক্যাল লিডারের কাছে পুরনো দিনের গল্প শুনছিল ক্যাপ্টেন রায়। গভর্নরের সঙ্গে একদল পুরনো দিনের বিপ্লবীদের মিটিং ছিল। মিটিং শেষে সবাই চলে গেলেন। শুধু গেলেন না উনি। গভর্নরের প্রোগ্রাম সম্পর্কে এ-ডি-সি-র সঙ্গে কথাবার্তা। বলছিলেন।
কথায় কথায় আলোচনার মোড় ঘুরে যায়।
জীবনে এই দ্বিতীয়বার গভর্নমেন্ট হাউসে এলাম।
মাত্র দুবার?
হ্যাঁ। পুরনো দিনের বৃদ্ধ বিপ্লবী একবার যেন চারপাশটা দেখে নিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর আজই প্রথম গভর্নমেন্ট হাউসে এলাম।
তাই নাকি?
বিপ্লবী ঘোষ মশাই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, আজই প্রথম।
ক্যাপ্টেন রায় জানতে চাইল, এর আগেও কি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?
বৃদ্ধ আর হাসি চাপতে পারলেন না।
ক্যাপ্টেন অবাক হয় ওর হাসি দেখে। জিজ্ঞাসা করে, হাসছেন যে?
হাসি থামার পর ঘোষ মশাই শোনালেন পুরনো দিনের সে কাহিনি।
পুলিশ কমিশনার টেগার্ড সাহেবের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ। বিপ্লবীদের অ্যারেস্ট করে লালবাজারে আনার পর টেগার্ড সাহেব তাদের প্রথম অভ্যর্থনা জানাতেন মুখে থুতু ছিটিয়ে…
ক্যাপ্টেন অবাক হয়, থুতু ছিটিয়ে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিপ্লবীদের হাজির করা মাত্রই উনি আগে ওদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিতেন। টেগার্ড সাহেবের সঙ্গে সর্বদা একটা হেড কনস্টেবল ও একজন সি-আই-ডি ইন্সপেক্টর থাকত। ওরা দুজনে অকথ্য অত্যাচার করতে ওইসব বিপ্লবীদের ওপর। টেবিলের ওপর বসে চুরুট খেতে খেতে টেগার্ড সাহেব সে দৃশ্য উপভোগ করতেন আর মাঝে মাঝে খেয়াল খুশি মতো বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের কাপড় তুলে বিশেষ বিশেষ স্থানে জ্বলন্ত সিগার চেপে ধরতেন।…
ক্যাপ্টেন শিউরে উঠে। বলেন কি জ্বলন্ত সিগার চেপে ধরতেন?
ইয়েস ইয়েস জ্বলন্ত সিগার! আপনার সঙ্গে যিনি কথা বলছেন তাঁর দেহেও এমনি অনেক স্মৃতিচিহ্ন আজও দেখতে পাবেন।