ক্যাপ্টেন লজ্জিত হয়। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আর সব কিছু গুলিয়ে ফেলি।
শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলার সময় তো মনে হলো না কিছু গুলিয়ে ফেলেছেন?
কান্ট ইউ ফরগেট শ্যামলী?
এমন একটা রোমান্টিক ক্যারেকটারকে চট করে ভোলা যায় না?
একটু থেমে মণিকা আবার জানতে চায়, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কি গুলিয়ে ফেললেন?
আমার কলিগ ন্যাভাল এ-ডি-সি ও তাঁর স্ত্রী আপনাকে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছে।
কোথায়?
এইতো নর্থ গেটের সামনেই ওদের কোয়ার্টারে।
কেন বলুন তো?
কেন আবার? আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
আপনি বুঝি ওদের কাছে আমার কথা বলেছেন?
বলেছেন মানে? রেগুলার আপনার কথা বলি।
সব কিছু বলেছেন?
ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবার মতো এখনও তো কিছু হয়নি। তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই বলব না।
কথাটা শুনেই মণিকার সারা মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সলাজ চোখের দৃষ্টিটা আনত হয়। ক্যাপ্টেন মুগ্ধ হয়ে দেখে।
কয়েক মিনিট এমনিভাবে কেটে গেল।
তারপর ক্যাপ্টেন বলল, সুড আই টেল মাই কলিগ অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ দ্যাট ইউ আর হিয়ার?
বলুন।
ক্যাপ্টেন টেলিফোনে লেফটেন্যান্ট ভাটিয়াকে জানাল, মণিকা ইজ হিয়ার।
ভাটিয়া কি যেন বলল।
অ্যাডমিরাল ইজ কামিং? ওয়ান্ডারফুল!
ক্যাপ্টেন রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই মণিকা প্রশ্ন করল, অ্যাডমিরাল কে?
ভাটিয়ার স্ত্রী সুনীতা। ওকে আমি অ্যাডমিরাল বলি।
ক্যাপ্টেন আবার একটা সিগারেট তুলতেই মণিকা বলল, আবার সিগারেট ধরাচ্ছেন যে?
তাতে কি হলো?
জামা-কাপড় চেঞ্জ করবেন না?
অ্যাডমিরালের ওখানে যাবার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবিই যথেষ্ট।
না না। চেঞ্জ করে নিন।
ক্যাপ্টেন চেঞ্জ করে বেরুতে না বেরুতেই সুনীতা এসে মণিকার সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিল।
গুড আফটার নুন অ্যাডমিরাল! কখন এলেন?
সুনীতা বলল, আর কথা নয় চলুন তাড়াতাড়ি। মণিকার দিকে ফিরে বলল, চলুন ভাই।
পরিচিতের সীমা যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন সবার ভালো লাগতে নাও পারে কিন্তু স্বীকৃতি যখন ছড়িয়ে পড়ে আপন পর পরিচিত-অপরিচিতের মধ্যে তখন সবার ভালো লাগে। মণিকারও!
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একটা সুন্দর মিষ্টি প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্ক অসামাজিক না হলেও সামাজিক নয়। কিছুটা স্নেহমমতা ভালোবাসা। বাংলাদেশের বাইরে বিদেশে বেশ। কয়েক বছর কাটিয়ে কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য মা-বাবা মণিকাকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মেলামেশা করতে বাধা দেননি। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের কাছে এই পরিচিতির স্বীকৃতি মণিকা আশা করে না।
লেফটেন্যান্ট ভাটিয়া ও সুনীতার কাছে সেই স্বীকৃতি পেয়ে বড় ভালো লাগল মণিকার।
আপনি শুনে অবাক হবেন ইওর গ্রেট ফ্রেন্ড নেভার টোল্ড আস এনিথিং অ্যাবাউট ইউ।
সুনীতা বাঁকা চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে কটাক্ষ করে মণিকাকে বলল।
মণিকা একটু হাসে। বলে, আমার সম্পর্কে কিছুই বলবার নেই।
আপনার বলবার কিছু না থাকলেও আমাদের শোনার অনেক কিছু আছে।
এবার ক্যাপ্টেন বলে, সুনিতা, ডোন্ট ট্রাই টু রিড বিটুইন দি নাইন্স্।
আমরা দুজনে কথা বলছি। এর মধ্যে তো আপনার মাথা গলাবার দরকার নেই।
বেশ লাগে মিসেস সুনীতা ভাটিয়াকে।
পরে মণিকা ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এদের সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দেননি কেন বলুন তো?
আগে আমার সঙ্গে ভালো করে পরিচয় হোক।
হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভালো করে পরিচয়?
আই মিন হোয়াট আই সে।
ক্যাপ্টেন একটু থামে। একবার দেখে নেয় মণিকাকে। মণিকাও ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে দেখে। মাঝপথে দেখা হয়।
এমন খুশির আমেজের সময়ই মণিকার মনে পড়ে মিস শ্যামলী গুপ্তার কথা।
তারপর বলুন মিস গুপ্তার কি ব্যাপার।
এত গল্প-গুজব হাসি-ঠাট্টার পরেও মিস গুপ্তাকে ভোলেননি?
ভুলব কেমন করে? গভর্নরের এ-ডি-সি-র সঙ্গে কলকাতার টপ-এর সোসাইটি গার্লের পরিবারে এমন ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ব্যাপারে কার জানার আগ্রহ হয় না বলুন?
ক্যাপ্টেন বলে, ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছি আপনার সঙ্গে আর লোকের আগ্রহ হবে মিস গুপ্তার খবর জানতে?
আমার মতো সাধারণ মেয়েকে নিয়ে দুনিয়ার কেউ আলোচনা করবে না।
ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে হেস্টিংস-এর দিকে এগোতে এগোতে ক্যাপ্টেন একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, আই উইস আই কুড সে হোয়াট আই ফিল লাইক সেইং।
কি বলতে চান বলুন। আমি কি আপনাকে বারণ করছি?
বারণ করেননি ঠিকই, তবুও…
ক্যাপ্টেন আর এগোতে পারে না।
মণিকাও নিশ্চয় জানতে চায় ক্যাপ্টেনের মনের কথা। নদীর পাড় দিয়ে হাঁটলে তো কোনোদিনই নদী পার হতে পারবেন না…
মণিকাকে আর বলতে হয় না।
ক্যাপ্টেন বলল, তবে বলছেন এবার নদীতে ঝাঁপ দিতে পারি?
মণিকা মজা করে। সাহস থাকলে নিশ্চয়ই ঝাঁপ দেবেন।
সাহস না আগ্রহ?
দুই-ই?
একটু পরেই মণিকা আবার বলল, চলুন আমাকে পৌঁছে দেবেন।
এক্ষুনি?
অনেকক্ষণ তত বেরিয়েছি।
ক্যাপ্টেন মনে মনে বলে, আচ্ছা মণিকা এখনও তোমার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করে? ভালো লাগে?
মনে মনে আরো কত কথা জানতে চায়, বলতে চায়, শুনতে চায় কিন্তু পারে না।
ক্যাপ্টেন ওইসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায়।
কি ভাবছেন?
ক্যাপ্টেনের হুঁশ ফিরে আসে। না, না কিছু ভাবছি না।
এমন কি ভাবছেন যা বলতে এত সঙ্কোচ?
একটু শুকনো হাসি হাসল ক্যাপ্টেন। বলে, ঠিকই ধরেছেন। বড় সঙ্কোচ, বড় দ্বিধা। কবে যে এর থেকে মুক্তি পাব।