রাজভবনের জীবন গতানুগতিকভাবে কাটে। সেই একই ইউনিফর্ম, স্যাফরন আর্ম-ব্যাচ; সেই সেলাম দেওয়া, সেলাম নেওয়া। সেই সভা-সমিতি, ডিনার-ড্যান্স-কটেল।
ক্যাপ্টেন রায় অভিনবত্ববোধ করে না এই নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কত জনের সঙ্গে দেখা হয়, আলাপ হয়। হাসি-ঠাট্টা গল্প-গুজবও হয় কিন্তু তাদের সঙ্গে নিবিড় হয়ে মিশতে উৎসাহবোধ করেন না। এসব কথা মণিকা জানে।
বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের বার্ষিক উৎসবে যোগদান করার জন্য লাটসাহেবের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রায়ও দুদিন বাঁকুড়া ঘুরে এল। মফঃস্বল শহরে গভর্নর এলেই একটু বেশি হৈ চৈ হয়। বাঁকুড়াতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বৃদ্ধ লাটসাহেবের পক্ষে এসব সহ্য করা সহজ নয়।
কলকাতায় ফিরেই লাটসাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হিজ একসেলেন্সির সব প্রোগ্রাম-এনগেজমেন্ট বাতিল করা হলো। চীফ মিনিস্টারও তখন কলকাতার বাইরে। গভর্নরের দস্তখতের জন্য সরকারি কাগজপত্র আসাও কদিন বন্ধ ছিল।
অনেকদিন পর সেদিন আবার মণিকা এসেছিল ক্যাপ্টেনের সঙ্গে গল্প করতে। বড় সোফাটায় দুটো পিলো মাথায় দিয়ে ক্যাপ্টেন কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে গুল্প করছিল মণিকার সঙ্গে। হঠাৎ টেলিফোন বাজল। বেশ বিরক্ত হয়েই ক্যাপ্টেন উঠে গেল টেলিফোন ধরতে।
ডান হাত দিয়ে চেয়ারটা টানতে টানতেই বাঁ হাত দিয়ে রিসিভারটা তুলল, ক্যাপ্টেন রয় হিয়ার?
একটু পরেই ক্যাপ্টেনের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল, গুড আফটারনুন, মিস গুপ্তা। কেমন আছেন?
মিস গুপ্তা শুনতেই মণিকা ঘাড় বেঁকিয়ে একবার ক্যাপ্টেনকে দেখল।
একটু পরে ক্যাপ্টেন মিস গুপ্তাকে বলল, মিঃ গর্ডন বোধহয় এ মাসের শেষের দিকে কলকাতা আসছেন। আই উইল সার্টেনলি ইনফর্ম ইউ হোয়েন হি কামস।
ক্যাপ্টেন একটু থামল। মণিকা আর একবার দেখল, হাসল।
নো নো মিস গুপ্তা। বিরক্ত হবে কেন? ইট ইজ এ প্রিভিলেজ টু গেট এ কল ফ্রম ইউ।
ক্যাপ্টেন টেলিফোন নামিয়ে রেখে ফিরে আসতেই মণিকা বলল, আই অ্যাম সরি।
কেন?
আমার জন্য একটু প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলেন না?
ক্যাপ্টেন একটু মুচকি হাসল। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।
নিচের ঠোঁটটা একটু কামড়ে মণিকা বলে, ট্রাই এগেন অ্যান্ড এগেন। নাউ ইউ হ্যাঁভ মাই বেস্ট উইসেস।
.
কলকাতা রাজভবনের একটা ট্রাডিশন আছে, মর্যাদা আছে, মোহ আছে। সমাজের পাঁচজনের মধ্যে একজন হতে হলে রাজভবনের সঙ্গে একটু মিতালি থাকা প্রয়োজন।
এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। লাটসাহেবের উমেদারী করে অনেকেই সমাজে এই স্বীকৃতি লাভ করেন। যারা পলিটিক্স করেন, স্বপ্ন দেখেন রাইটার্স বিল্ডিং-এর দোর গোড়ায় সাব ইন্সপেক্টর সেলাম দিচ্ছে, তাদের ইষ্টদেবতা লাটসাহেব নয়। যারা পলিটিসিয়ান কাম সোস্যাল ওয়ার্কার কাম বেনামী বিজনেসম্যান, যারা অন্য কোথাও কল্কে পান না, তারাই লাটসাহেবের সান্নিধ্য লাভের জন্য একটু বেশি লালায়িত।
এদের ড্রইংরুমে, অফিস ঘরে লাটসাহেবের ফটো লটকান থাকে। সুতরাং চিনতে কষ্ট হয়। রাজভবনের সঙ্গে আরো বহু ধরনের মানুষের যোগাযোগ আছে। কারণে, অকারণে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। এদের সবাইকেই চেনা যায়, জানা যায়, বোঝা যায়।
বোঝা যায় না, জানা যায় না আরতি সরকার, শ্যামলী গুপ্তা, অলকা মিত্র, উজ্জ্বলা সেনকে। বাইরের কেউ জানতে না পারে, বুঝতে না পারে কিন্তু এ-ডি-সি? নাটকের অন্তিম দৃশ্য দুচোখ। দিয়ে না দেখলেও সব কিছু বুঝতে পারে, জানতে পারে।
ক্যাপ্টেন টেলিফোন শেষ করে ও পাশের সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরাল। দৃষ্টিটা হয়তো মুহূর্তের জন্য ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁক দিয়ে একটু ঘুরে এলো।
মণিকা একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, মনটা একটু উদাস হয়ে গেল, তাই না?
মুচকি হাসতে হাসতে চেয়ে রইল ক্যাপ্টেনের দিকে।
ক্যাপ্টেন হাসল। আমার ওপর রাগ হয়েছে তো?
না, রাগ করব কেন?
মিস গুপ্তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললাম বলে।
আফটার অল আপনি একজন আর্মি অফিসার; তারপর আবার এ-ডি-সি। সুতরাং আপনার সঙ্গে যে শুধু মণিকা ব্যানার্জির আলাপ নেই…।
ক্যাপ্টেন বাধা দেয়, তবু বলবেন রাগ করেননি?
না না, রাগ করব কেন?
আপনার সামনে থেকে সিগারেট তুলে নিলাম, কই আপনি তো লাইটার জ্বেলে ধরলেন না?
মণিকা লজ্জা পায়। সরি।
ক্যাপ্টেন কিন্তু মনে মনে খুশি হয়। ভালোবাসা না থাকলে কি ঈর্ষা আসে?
মিছিমিছি সন্দেহ করবেন না। এখানে চাকরি করতে এসে আপনাদের কলকাতার অনেক কিছু জানলাম! ভবিষ্যতে সুযোগ এলে আপনাকে বলব।
মণিকা, আবার একটু মুচকি হাসে। মিস গুপ্তার স্টোরি বলার দিন কি অ্যাট-অল আসবে?
আই হোপ সো বাট ইট ডিপেক্স অন ইউ।
তার মানে?
শ্যামলী গুপ্তার স্টোরি এখন আমি বলতে পারব না, আপনি শুনতেও পারবেন না।
কেন?
ক্যাপ্টেন একটু ভাবে। আমাদের পরিচয়টা আরো একটু গভীর না হলে ওইসব মেয়েদের কাহিনি বলতে ও শুনতে দুজনেরই লজ্জা করবে।
টানা টানা ভ্রূ দুটো উঁচু করে মণিকা বলে, ইজ, ইট সো রোমান্টিক?
নট রোমান্টিক বাট ভালগার!
মণিকা সঙ্গে সঙ্গে বলে, শুনেছি অধিকাংশ পুরুষই ভালগারিটি পছন্দ করে।
মিছিমিছি কথা কাটাকাটি করে চলে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ।
শেষে মণিকা বলে, তর্ক করছি বলে কি একটু কফিও খাওয়াবেন না।