মজা লাগে মণিকার, তার মানে?
আজ নয় পরে বলব।
বেশ কেটেছিল সেদিনের অপরাহ্ন। বিদায়বেলায় বনমালী এক টুকরি ভর্তি পাকা পেঁপে দিয়ে বলেছিল, দিদিমণি মাকে বলল এগুলো কালকের মধ্যেই খেয়ে ফেলতে, নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে।
মণিকা এক ফাঁকে বনমালীকে ক্যাপ্টেনের পরিচয় দিয়ে এসেছিল। ক্যাপ্টেন তা জানত না।
বনমালী ক্যাপ্টেনকে বলল, আপনি লাটসাহেবের বাড়িতে থাকেন, কত মস্ত লোক। দয়া করে যে এসেছেন…
ক্যাপ্টেন আর এগোতে দিল না। মণিকার দিকে ফিরে বলল, এর ফাঁকে কখন ওকে এসব শিখিয়ে পড়িয়ে এলেন?
মিটমিট করে হাসতে হাসতে মণিকা বলল, হ্যাঁ বনমালীদা, তোমাকে আমি কিছু শিখিয়েছি?
বনমালী অত সাদা মিথ্যা কথাটা বলতে পারল না। মণিকার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ক্যাপ্টেনকে বলল, সময় পেলে দয়া করে আসবেন।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে যশোর রোডের ওপর আসার পরই ক্যাপ্টেন মণিকাকে বলল, বনমালীকে বলে দেবেন আমি মাঝে মাঝেই আসব।
মণিকা বলল, তাই নাকি?
কলকাতা ফেরার পথে গাড়ির স্পীডটা বেশ কম ছিল।
মণিকা জানতে চাইল, কি ব্যাপার? এত আস্তে চালাচ্ছেন? গাড়িতে কোনো ট্রাবল…
জোরে চালালেই তো এক্ষুনি সব ফুরিয়ে যাবে।
মণিকা কিছু বলে না। ক্যাপ্টেনও একটু চুপ করে থাকে। তারপর আবার বলে, ওই গরাদখানায় যেন আর মন টেঁকে না।
দুর থেকে রাজভবনের মানুষগুলোকে কত সুখী মনে হয়। মনে হয় ওরা সবাই সুখ-সম্ভোগ আনন্দ-বিলাসে মত্ত। ওখানে যারা থাকে, তাদের কি সাধারণ মানুষের মতো সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকে? দূর থেকে যারা রাজভবনকে দেখে তারা মনে করে, না। এত প্রাচুর্য, আনন্দবিলাসের মধ্যে কি দুঃখ থাকতে পারে?
ক্যাপ্টেনকে দেখে মণিকার উপলব্ধি হয়েছে, না ওখানকার সবাই সুখী হয়। মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতা ফেরার পথে সে কথাটা আরো বেশি করে উপলব্ধি করল।
এ-ডি-সি হবার আগে কি করে সময় কাটাতেন?
আর্মি লাইফে একটা সুন্দর উত্তেজনা আছে। বেশ কাটত দিনগুলো। কিন্তু এখানে তো কেউ প্রাণ খুলে হাসতেও পারে না।
হোয়াট অ্যাবাউট গভর্নর?
দুঃখের মধ্যেও ক্যাপ্টেনের হাসি পায়। তার অবস্থা আরো সঙ্গীন। আমি তো আমজাদের সঙ্গে গল্প করতে পারি, মণিকা ব্যানার্জিকে নিয়ে মধ্যমগ্রামে যেতে পারি, ভবিষ্যতে সিনেমা দেখতে পারি…
ক্যাপ্টেনের কথা শুনেই মণিকা হাসে, কে বলল আপনার সঙ্গে আমি সিনেমায় যাব?
কথাটা যেন কানেই তুলল না ক্যাপ্টেন।…লাটসাহেবের তো সে স্বাধীনতাও নেই।
০৯. রাজভবনের কথা
রাজভবনের কথা আর কাকে বলবে? না বলে মনে শান্তি পায় না ক্যাপ্টেন রায়। লাটসাহেবের অসহায় অবস্থার কথাও বলে।
বিশ্বাস করুন ব্যারাকপুরের গঙ্গার ধারে ওই বাগানবাড়ি আর দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাউসে ছাড়া অন্য কোথাও যেতে হলেই লাটসাহেবকেও চীফ মিনিস্টারের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়।
মণিকা অবাক হয়ে বলে, রিয়েলি?
কত সরকারি অনুষ্ঠানে লাটসাহেবকে নেমন্তন্ন করেও পরে ক্যানসেল করা হয় চীফ মিনিস্টারের ইচ্ছায়…
হাঁটু দুটোকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে বসে থাকতে থাকতে মণিকা আবার প্রতিবাদ করে, কি যা তা বলছেন?
ভ্রু কুঁচকে মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবে মণিকা। তারপর আবার বলে, আপনি এ-ডি-সি বলে ইউ কান্ট সে হোয়াট এভার ইউ লাইক।
ক্যাপ্টেন রায় হাসে। হাসতে হাসতে চেয়ে থাকে মণিকার দিকে। কিছু বলে না, যেন বলতে চায় না।
ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে মণিকাও হাসে, কি? ভেবে দেখছেন এবারে কি বানিয়ে বানিয়ে বলবেন?
ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতেই বলে, মিথ্যা কথা বলে আমার কি লাভ? তাছাড়া আপনাকে আমি মিথ্যা কথা বলব?
কথাটা বড় ভালো লাগে মণিকার। সংযত সংহত পরিবেশের মধ্যেও একটু যেন নিবিড়তা অনুভব করে।
চোখ দুটো বড় বড় করে মণিকা বলে, আমাকে মিথ্যা কথা বলতে নেই?
একটু ভেবে উত্তর দেয় ক্যাপ্টেন, না, ঠিক তা নয়; তবে আপনাকে মিথ্যা কথা বলে আমিই মনে মনে শান্তি পাব না।
লাটসাহেবের দুরবস্থার আরো অনেক কাহিনি মণিকাকে বলেছিল ক্যাপ্টেন রায়। যাকে প্রতি পদক্ষেপে স্যালুট করব, যাঁর হুকুম তামিল করাই আমাদের কাজ, তার এই অসহায় অবস্থা দেখে আমাদেরই খারাপ লাগে।
সরকারি-বেসরকারি অফিসে ছোট-বড় অফিসারদের অপমান দেখতে দেখতে অভ্যস্ত থাকেন। তাদের সহকর্মীরা কিন্তু আর্মিতে এসব দেখা দুর্লভ ব্যাপার, অসম্ভব ব্যাপার। তাই তো এ-ডি-সি-র চাকরি করতে এসে ক্যাপ্টেন রায় মনে মনে আহত হন প্রতি পদক্ষেপে। উত্তরবঙ্গের সর্বনাশা বন্যার খবর কলকাতায় পৌঁছাবার পর পরই লাটসাহেব ঠিক করলেন নিজের চোখে দেখে আসবেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। রাইটার্স বিল্ডিংস-এ লাটসাহেবের অভিপ্রায়ের খবর। পৌঁছাবার একটু পরই লাটসাহেবের সেক্রেটারিকে জানান হলো, না না, এক্ষুনি লাটসাহেবের যেতে হবে না। সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা উদ্ধার কার্যে ব্যস্ত। লাটসাহেব গেলে এইসব জরুরি কাজকর্ম বন্ধ করে তার দেখাশুনা করতে হবে সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের।
অথচ…
দুদিন পরই চীফ মিনিস্টার নিজে গেলেন নর্থ বেঙ্গল।
মণিকা ঠিক বুঝতে পারে না তাৎপর্য, তাতে কি হলো?
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যে ভি-আই-পি প্রথম যান, তার ছবি, নিউজ খবরের কাগজে বেশি ছাপা হয়। ফিল্ম ডিভিশনের নিউজ রিলে বা রেডিওতে বেটার কভারেজ পায় সুতরাং…