পৌনে নটা নাগাদ ছোট্ট একটা তুড়ির আওয়াজ! মীরমদন, মীরকাশিমের দল সম্ভ্রমে সন্ত্রস্ত হয়ে আর একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন রায় সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ইউনিফর্মটা একটু ঠিক করে নিয়েই বেরিয়ে করিডোরে গেলেন। মুহূর্তের মধ্যেই গভর্নর সাহেব বেরিয়ে এলেন অন্দরমহল থেকে।
স্মার্ট আর্মি অফিসারের মতো ক্যাপ্টেন রায়ের দুটো বুটে একটা ছোট্ট ঠোকাঠুকি আর সঙ্গে সঙ্গে একটা স্যালুট।
গভর্নর সাহেব ডান হাতটা তুলে প্রত্যভিবাদন জানালেন।
তারপর একটু মাথা নীচু করে ক্যাপ্টেন রায় বললেন, গুডমর্নিং! ইওর একসেলেন্সী!
গুডমর্নিং!
সিরাজের সৈন্যবাহিনী করজোড়ে মাথা নীচু করে প্রভুভক্তি দেখাল।
গভর্নর নিজের অফিস কক্ষে গেলেন। ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করলেন এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায়।
গভর্নর সাহেব চেয়ারে বসে বলেন, আজ কেয়া হ্যায়?
স্যার, সকালে তিনজন ভিজিটার্স আছেন। আফটারনুনে মরক্কোর অ্যাম্বাসেডর আসবেন আর ইভনিং-এ মিস রমলা যোশীর একজিবিশন ওপেনিং আছে।
কোনো গেস্ট আসছেন নাকি আজ?
লেট নাইটে বম্বে থেকে ইউনিয়ন ডেপুটি মিনিস্টার ফর সাপ্লাই আসছেন।
গভর্নর সাহেবের চোখমুখ দেখে মনে হল ডেপুটি মিনিস্টার সাহেবের আগমনের খবর শুনে মোটেও খুশি হলেন না।
হাউ লং উইল হি স্টে হিয়ার?
স্যার, উনি চারদিন থাকবেন।
চা-র-দি-ন?
ইয়েস স্যার।
এ-ডি-সি তো নিজের লোক। গভর্নর সাহেব আর মনের কথা চেপে রাখতে পারেন না। বলেন, বুঝলে ক্যাপ্টেন, আগে এইসব লোক বড়বাজারের গলিতে কোনো কাটা কাপড়ের দোকানদারের বাড়িতে উঠত! একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলে পারলেন না হিজ এসেলেন্সী। আর আজ! এরাও গভর্নমেন্ট হাউসে উঠছে!
কথাটা বলেই শাস্তি পেলেন না। সমর্থনের জন্য এ-ডি-সি-র দিকে তাকালেন।
ক্যাপ্টেন রায় কি করবেন? মাথাটা একটু নেড়ে চাপা গলায় বললেন, ইয়েস স্যার!
বুঝলে ক্যাপ্টেন…
গভর্নর সাহেব আরো কি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। দরজার কোণা থেকে একজন বেয়ারা এ-ডি-সি সাহেবকে কি যেন একটা ইসারা করল।
এক্সকিউজ মি স্যার! আমি এক মিনিটের মধ্যেই আসছি।
ক্যাপ্টেন রায় চটপট বেরিয়ে নিজের অফিসে গিয়েই নামিয়ে রাখা টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিলেন।…ক্যাপ্টেন রয় হিয়ার…।
ওপাশ থেকে কিছু শোনার পর ক্যাপ্টেন রায় বললেন, উনি এসে গেছেন? দ্যাটস অল রাইট। উপরে পাঠিয়ে দিন।
এ-ডি-সি আবার গভর্নরের অফিসে গেলেন।
স্যার, মিঃ জগতিয়ানী আসছেন। এখানেই বসবেন নাকি ড্রয়িংরুমে যাবেন?
আরো তো অনেকে আসছেন। অনেকক্ষণ তো বসতে হবে, সো লেট মি গো টু ড্রইংরুম।
গভর্নর ড্রইংরুমে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন রায় গেলেন নিজের অফিসে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেয়ারা মিঃ জগতিয়ানীকে নিয়ে এল এ-ডি-সি-র ঘরে।
ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিলেন। করমর্দন করতে করতে বললেন, হাউ ডু ইউ ডু স্যার?
আই অ্যাম ফাইন। হাউ ডু ইউ ডু?
ক্যাপ্টেন সিগারেট কেসটা এগিয়ে দিলেন।
না, না, আমি সিগারেট খাই না।
বাঃ, আপনি তো বেশ বাংলা বলেন।
ভবানীপুরে জন্মেছি, সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়েছি। বাংলা বলব না?
ক্যাপ্টেন রায় খুশি হন। মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
মিঃ জগতিয়ানী মজা করার জন্য বললেন, আমি যা বাংলা বই পড়েছি, তা বোধহয় আপনাদের মতো অনেক অফিসারই পড়েননি।
খুব ভালো কথা।
ক্যাপ্টেন রায় হাতের ঘড়িটা দেখেই বাজার বাজালেন। বেয়ারা ঘরে আসতেই মিঃ জগতিয়ানীর নাম ছাপান স্লিপটা তাকে দিলেন। একটু পরেই বেয়ারা ফিরে এল। ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন।
ড্রইংরুমের দরজায় দুবার নক করেই এ ডি-সি ভিতরে ঢুকলেন।
…স্যার, মিঃ জগতিয়ানী ইজ হিয়ার।
মিঃ জগতিয়ানী ঘরে ঢুকতেই ক্যাপ্টেন রায় বেরিয়ে এলেন। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বেয়ারা চা আর কিছু নাটস্ নিয়ে ওই ঘরে ঢুকল।
নিজের অফিসে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন রায় সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছাড়লেন।
ওই চেয়ারে বসেই একটু কাত হলেন। একটু যেন তলিয়ে গেলেন। এ-ডি-সি-র চাকরিতে মজা অনেক। তবে সব চাইতে বেশি মজা বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে।
আবার সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন ক্যাপ্টেন রায়।
স্কুলে পড়ার সময় মনে হতে কত ছেলের সঙ্গে ভাব। তারপর কলেজে পড়বার সময় মনে হয়েছিল, দুনিয়ার সবার সঙ্গেই আলাপ হয়ে গেছে। মানুষ সম্পর্কে এত অভিজ্ঞতা বোধ করি আর কারুর হয়নি, হতে পারে না। আরো পরে আর্মিতে ঢোকার পর মনে হল, দুনিয়ার বিচিত্র মানুষদের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় হল।…
দেরাদুন ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমির মেসের একই ঘরে থাকত ওরা দুজনে। ক্যাপ্টেন রায় তখন ক্যাডেট রায়। ক্যাডেট কমল রায়। জেনকিন্সও এই ব্যাচের ছিল। পার্ক সার্কাসের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্ম হলেও মনে মনে পুরোপুরি বাঙালি ছিল। কবিতা লিখতে জানত না বটে তবে ভাব প্রবণতায় বাঙালির ছেলেদেরও হার মানাত। প্রবাসী বাঙালি বলে কমল বরং ওর চাইতে অনেক কম ভাবপ্রবণ ছিল। তবু বড় ভাব ছিল দুজনে।
ছুটির দিনে দুজনে সাইকেলে চেপে প্রথমে যেত এফ-আর-আই-এর ওই ছোট্ট মার্কেটের কোণার নোংরা রেস্তোরাঁয়।
জেনকিন্স বলত, বাঙালি হয়ে নোংরা রেস্টুরেন্টে না খেলে যেন মন তৃপ্ত হয় না।