ঠিক বলেছেন।
কোটিপতি ইন্ডিয়ানদের বাড়িতেও একটা আবছা আবছা ভারতীয় পরিবেশ পাবেন, কিন্তু এখানে তাও নেই।
অনেকটা হোটেল-হোটেল অ্যাটমসফিয়ার।
না, তাও না। হোটেলে মানুষ স্বাধীনভাবে হাসে, খেলে, গান গায় কিন্তু রাজভবনে সে অ্যাটমসফিয়ারও নেই।
এমন পরিবেশের মধ্যে থাকতে কষ্ট হয় না?
স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার মোড় ঘুরে ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে তাকাল মণিকার দিকে। দারুণ কষ্ট হয়, কিন্তু কে আমাকে মুক্তি দেবে বলুন?
মণিকা আস্তে মাথাটা নীচু করল। মুখে কিছু বলল না।
.
ফার্মে সময়টা বেশ কেটেছিল। গাড়ি থেকে মণিকাকে নামতে দেখেই বনমালী ছুটতে ছুটতে এসে বলল, কি দিদিমণি? কি ব্যাপার?
বনমালী এক ঝলক ক্যাপ্টেনকেও দেখে নিল।
কি আবার ব্যাপার? তোমাকে দেখতে আসব না?
আনন্দে খুশিতে প্রায় লুটিয়ে পড়ল বৃদ্ধ বনমালী। তোমরা ছাড়া আমাকে আর কে দেখে বল?
এবার মণিকা ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা যখন রাজশাহী কলেজে, তখন থেকে বনমালী আমাদের সঙ্গে আছে। আমি এরই কোলে চড়ে মানুষ হয়েছি।
ইজ ইট?
হ্যাঁ। বনমালী হচ্ছে বাবার প্রাইভেট সেক্রেটারি।
বনমালীর মুখে আবার সেই খুশির হাসি। কি যে বল দিদিমণি!
একটু পরেই বলল, চল, চল ভিতরে যেয়ে বসবে চল।
ফার্মের এক কোণায় ছোট্ট দুখানি ঘর। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন বলল, বেশ বোঝা যায় কোনো অধ্যাপকের ঘর।
বনমালী চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি আজ এসে ভালোই করেছ।
কেন?
কতকগুলো পেঁপে পেকে উঠেছে। আজকালের মধ্যে না খেলে নষ্ট হয়ে যাবে!
আবার ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে চাইল মণিকা, জানেন বনমালী কোনোদিন নিজের সংসার করল না কিন্তু আমাদের সংসার নিয়েই ও পাগল!
বনমালীর আদর-অভ্যর্থনার পর্ব শেষ হল। জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি, তোমরা কিছুক্ষণ আছ তো?
হ্যাঁ।
আমি তাহলে একটু ওদিকে যাচ্ছি। যাবার আগে আমাকে ডাক দিও কিন্তু।
নিশ্চয়ই!
বনমালী চলে গেল। যতক্ষণ ওকে দেখা গেল, ক্যাপ্টেন ওর দিকেই চেয়ে রইল। তারপর মণিকার দিকে ফিরে বলল, এই যুগেও এমন বনমালী পাওয়া যায়?
সত্যি হি ইজ এ রেয়ার ক্যারেকটার! তাছাড়া আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
ছোট্ট একটু মুচকি হাসি হেসে ক্যাপ্টেন বলে, আপনাকে দেখছি সবাই ভালোবাসে!
ঠাট্টা করছেন? চোখের কোণে একটু বিদ্যুৎ হাসির ইঙ্গিত ফুটিয়ে মণিকা জানতে চায়।
প্রফেসর মঙ থেকে শুরু করে বনমালী পর্যন্ত সবাই-ই আপনাকে ভালোবাসে।
আপনাকে যতটা উদার ভেবেছিলাম, এখন দেখছি তা নয়।
ইজ ইট?
তবে কি?
মণিকা একটু হাসে, একটু চুপ করে। তারপর বলে, এখানে বসে বসে ঝগড়াই করবেন, নাকি একটু ঘুরে দেখবেন?
মজা করে ক্যাপ্টেন, এখানে বসে বসে ঝগড়া করতে পারলেই বেশি খুশি হতাম, কিন্তু বনমালী হয়ত পছন্দ করবে না।
ক্যাপ্টেন একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, চলুন একটু ঘুরেই আসি।
চলুন।
বাগানটি খুব বড় না হলেও নেহাত ছোট নয়। দেশ-বিদেশ ঘুরে এলে যে রুচিবান বাঙালিরও রুচির উন্নতি হয়, বাগানে ঘুরলেই তা নজরে পড়ে।
একি? স্ট্রবেরি?
মণিকা জবাব দেয়, হ্যাঁ।
ক্যাপ্টেন একটা সিগারেট ধরিয়ে মণিকার দিকে ফিরে বলল, বাঙালি একটু বাইরে ঘুরে-ফিরে এলে দৃষ্টিভঙ্গিটা অনেক পাল্টে যায়, তাই না?
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মণিকা বলে, হঠাৎ একথা বলছেন?
এই আপনাকে আর ওই স্ট্রবেরি গাছটা দেখে মনে পড়ল।
তার মানে?
বাংলাদেশের বাঙালির বাগানে আম-জাম-কলা পাবেন, পাবেন না স্ট্রবেরি।
কিন্তু তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?
হ্যাড ইউ বিন এ পিওর বেঙ্গলি গার্ল, তাহলে কি এত ফ্রি হতে পারতেন?
হোয়াট ডু ইউ মীন বাই এ পিওর বেঙ্গলি গার্ল?
মানে আপনার জন্ম-কর্ম, শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুই যদি বাংলাদেশে হতো…
ক্যাপ্টেন এক ঝলক দেখে নেয় মণিকাকে। মণিকা মাথা নিচু করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। খোঁপাটা ঢিলে হয়ে ঘাড়ের কাছে পড়েছে। কানের পাশ দিয়ে লম্বা জুলফির চুলগুলো ওর গালের উপর এসে পড়েছে। ক্যাপ্টেনের বেশ লাগছে ওকে দেখতে।
মণিকা এবার মুখ উঁচু করে ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে বলে, তাহলে কি হতো?
কি না হতে বলুন? আপনার সঙ্গে আমার মেলামেশার সুযোগ হতো?
কলকাতার কলেজ-ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলেমেয়ে কমনরুমে বা কফি হাউসে একসঙ্গে গল্প-গুজব-আড্ডা দিলেও সহজ-সরলভাবে মেলামেশার পথে অনেক বাধা অনেক বিপত্তি।
সে কথা মণিকা জানে। জানে কলকাতা শহরে পাশাপাশি বাড়িতে ওরা দুজনে আজন্ম বাস করার পরও ক্যাপ্টেন বলতে পারত না চল মণিকা একটু বেড়িয়ে আসি। কিন্তু কলকাতার বাইরে বরাকরের ওপারে পাটনা, এলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, বোম্বের বাঙালি ছেলেমেয়েরা অনেক ঘনিষ্ঠ হতে পারে। শুধু ছেলে-মেয়েরা কেন? মা-বাবাও।
তাইতো ক্যাপ্টেন বলল, আপনার বাবা যদি শেয়ালদা কোর্টের উঁকিল হতেন আর সারপেনটাইন লেনেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতেন তাহলে কি তার মেয়েকে এত স্বাধীনতা দিতেন?
বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দুচারটে পাখির ডাক হয়তো কানে এসেছিল ক্যাপ্টেনের। ঢলে পড়া সূর্যের গোলাপি রশ্মি বোধহয় মনটাকেও একটু রঙিন করেছিল। বনমালী না থাকলে আপনাকে একটা গান গাইতে বলতাম।
মণিকা হাসি চাপতে পারে না, বনমালীকে এত ভয় কেন?
ভয় না করলেও ওর বিরক্তিতে ভবিষ্যৎ নষ্ট করব কেন?