মনে মনে ভাবতে গিয়েও ঠোঁটটা বোধহয় একটু নড়েছিল, একটু কেঁপেছিল। মণিকার দৃষ্টি এড়ায়নি।
কি বলছেন মনে মনে? গালাগালি দিচ্ছেন না তো?
মনের কথাও জানতে পারে মণিকা? ক্যাপ্টেন চমকে ওঠে। কি করে বুঝলেন মনে মনে কিছু বলছি?
এটা মেয়েদের ট্রেড-সিক্রেট। বলতে নেই।
তাই নাকি?
তবে কি?
মিসেস ব্যানার্জি ঘরে ঢুকেই একটা প্লেট এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেনের দিকে।
মাছ ভাজা দুটো খেয়ে নাও।
সে কি মাসিমা?
রান্নাবান্না কিছু হয়নি। আজ খেতে খেতে অনেক দেরি হবে!
মা-মাসির কাছে এলে না খেয়ে কে যায়? মিসেস ব্যানার্জি আর কথা না বলে ভিতরে চলে গেলেন।
মণিকা তখনও দাঁড়িয়ে।
ক্যাপ্টেন জানতে চাইল, বসবেন না?
মণিকা পাশের বুক শেলফ-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, সারাদিন শুয়ে-বসে তো টায়ার্ড হয়ে গেলাম। আপনার মতো মুক্ত বিহঙ্গ হলে তো বেঁচে যেতাম।
এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা।
ভ্রু কুঁচকে বাঁকা চোখে মণিকা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি আটকে রেখে জানতে চাইল, একটা কথা বলবেন?
আপনাকে না বলার মতো তো কিছু নেই।
এত কাব্য সাহিত্য চর্চা করলেন কোথায়?
আমার কর্মজীবনে কাব্য-সাহিত্যের স্থান নেই বলেই অবসর কাটাই কাব্য পড়ে।
ক্যাপ্টেন একটু থামে। মুখটা উঁচু করে মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে, তাছাড়া অবসর যে প্রচুর! একটু গল্প করে সময় কাটাবার মতো কেউ নেই আমার। গত্যন্তর নেই বলেই শুয়ে শুয়ে বই পড়ি।
আমাদের এখানে চলে এলেই তো পারেন।
আপনিও তো আসতে পারেন আমার ওখানে।
কোনোদিন তো বলেননি।
সব কথাই কি বলতে হয়?
তা বটে। আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে, তোমার ভাবনা তারার মতো বাজে। মণিকা বোঝে বৈকি।
সত্যি, আমার যাওয়া উচিত ছিল।
মণিকা গিয়েছিল। টেলিফোন করে ক্যাপ্টেনের ছুটির দিনে গিয়েছিল।
নর্থ গেট পুলিশ অফিস থেকে টেলিফোন পাবার পরই ওই পায়জামা পাঞ্জাবি পরেই ক্যাপ্টেন গিয়েছিল পোর্টিকোতে মণিকাকে অভ্যর্থনা জানাতে।
ইউনিফর্ম বা স্যুট পরতেই দেখেছে এর আগে। নতুন বেশে বেশ লাগল। লিফট-এর ওখানে পৌঁছে ক্যাপ্টেন বাট পুশ করল। পাশে দাঁড়িয়ে মণিকা এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, আজ এই পোশাকে তো বেশ লাগছে!
থ্যাঙ্ক ইউ। আবার থ্যাঙ্ক ইউ বলছেন? অমন করে প্লিজ আর থ্যাঙ্ক করলে এক্ষুনি চলে যাব।
এর মধ্যে লিট নেমে এলো। মুখের ঝগড়া চোখের হাসিতে মিটমাট হয়ে গেল। তবে নিজের ঘরে ঢুকেই ক্যাপ্টেন বলল, বার্মিজ মেয়েদের মতো আপনি একটু শাসন করতে পছন্দ করেন, তাই না?
শুধু বার্মিজ মেয়েরাই নয়, সব দেশের মেয়েরাই পুরুষদের উপর খবরদারি করতে পছন্দ করে। আমিও পছন্দ করি!
থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর ফ্র্যাঙ্কনেস্।
মণিকা বসেছে। ক্যাপ্টেন তখনও দাঁড়িয়ে।
বসুন।
বসছি।
নাকি ভাবছেন সিরাজদৌল্লার ওই পরাজিত সৈনিকদের ডেকে কাটলেট-ওমলেট চা-কফির অর্ডার দিতে হবে?
মণিকার কথায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন না হেসে পারে না।
মণিকা আবার বলে, আচ্ছা এখানকার খাবার-দাবার খেতে আপনার ভালো লাগে?
ভালো লাগলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়? নাকি, খারাপ লাগলেই দুরে রাখা যায়?
মণিকা কথাটা ঘুরিয়ে দেয়, এখানকার কাটলারিজ ক্রকারিজ দেখলেই কি মনে হয় জানেন?
কি?
মনে হয় সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাতিয়া তোপি, ঝাসির রানির প্যালেস লুঠ করে এসব জোগাড় করা হয়েছিল। আর কিছু এসেছিল উইন্ডসর ক্যাসেল-এর পুরনো স্টোর রুম থেকে।
দুজনে হাসে। হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মণিকার দিকে। বেশ লাগে মণিকাকে। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর হঠাৎ লজ্জা লাগে।
দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, বসুন।
এবার ক্যাপ্টেন বসে। একই কৌচের অপর কোণায়।
সেন্টার টেবিল থেকে সিগারেট-কেস খুলে একটা সিগারেট তুলে নেয়। মণিকা সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেয় লাইটার। জ্বালিয়ে ধরে ক্যান্টেনের সামনে। সে একটা টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বলে, ধন্যবাদ জানাব?
প্রয়োজন নেই!
আরো দু-একবার সিগারেট টান দিয়ে ক্যাপ্টেন বলে, চা আনতে বলি?
নাক উঁচু করে, ঠোঁটটা উল্টে মণিকা বলল, চা? এখানে নয়, চলুন বাইরে খাব।
চলনু বলেই ক্যাপ্টেন উঠে পড়ল। ঘরের কোণায় ওয়াড্রোব খুলে একটা লাইট কালারের সুট বের করে বাথরুমের দিকে এগুতে গেলেই মণিকা বলল, ছুটির দিনেও স্যুট পরবেন?
তবে কি পরব?
কেন, আপনার ধুতি নেই?
সরি! একটাও ধুতি নেই।
সে কি? বাঙালির ছেলে অথচ একটাও ধুতি নেই?
বাঙালিপনা দেখাবার সুযোগ পেলাম কোথায় বলুন?
একটু থেমে ক্যাপ্টেন জানতে চায়, কেন, স্যুট পরলে কি দেখতে খারাপ লাগে?
না, না, তা তো বলিনি। তবে বাঙালির ছেলেরা মাঝে মাঝে ধুতি-পাঞ্জবি পরবে বৈকি।
ধুতি না পরার জন্য মার কাছেও কি কম বকাবকি শুনি?
এবার আরো শুনবেন।
তা তো বুঝতেই পারছি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্যাপ্টেন স্যুট-টাই পরে বেরিয়ে এলো।
বেশি দেরি করি নি তো?
বার্মিজ মেয়েরা আরো অল্প সময় নেয়। নীচের ঠোঁটটা ডান দিকে টেনে চাপা হাসি মুখে এনে মণিকা বলল।
ভগবান সবাইকে তো আপনার মতো রূপ দিয়ে পাঠান না।
যেমন বোলিং তেমনি ব্যাটিং। তাছাড়া ক্রিজটাও বোধকরি ভালো ছিল। অপরাহ্নের ক্লান্ত সূর্য রাজভবনের চারপাশের পাম গাছের মধ্য দিয়ে উঁকি দিতে দিতে গোধূলির আলাপ শুরু করে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে দুটো একটা কোকিলের ডাকও ভেসে আসছিল।