আমজাদ-রমজানের সঙ্গে গল্প করেছেন। ডায়ানা-ডরোথির গল্প শুনেছেন। পুরনো দিনের গভর্নমেন্ট হাউসের কাহিনি শুনেছেন, অফিসারদের নোংরামি জেনেছেন। তাদের নিয়ে সময় কেটেছে। ব্যস, তার বেশি কিছু নয়। লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে গেলে সতীনাথের অতৃপ্ত আত্মার ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আশেপাশেই কোথাও মিস বিশ্বাসকে দেখতে পায়।
সময় কাটে আরো নানা ভাবে। সভা-সমিতিতে, পার্টি রিসেপশনে ককটেলে। তবুও ক্যাপ্টেন নিঃসঙ্গ থেকে যায়।
সেদিন রাত্রে নেমন্তন্ন খেয়ে আসার পর অনেকবার টেলিফোন করতে ইচ্ছা করেছে, আগ্রহ হয়েছে। তবুও করেননি। লজ্জা, সংকোচ আর কিছু আত্মসম্মানবোধ বাধা দিয়েছে।
আর দেরি করলেন না। হাজার হোক একটা ধন্যবাদ জানানো কর্তব্য। বেটার লেট দ্যান নেভার।
আমি ক্যাপ্টেন রায় বলছি।
ডক্টর ব্যানার্জি প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিলেন। টেলিফোনের ঘণ্টা শুনে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন।
কেমন আছ?
ভাল। আপনি ভালো আছেন?
হ্যাঁ, এর মধ্যে এসো। আমি একটু বেরুচ্ছি। তুমি কথা বলল।
ডক্টর ব্যানার্জি চলে গেলেন।
মণিকা ভেবেছিল কোনো পুরনো ছাত্র হবে।
আমি মণিকা বলছি।
আমি ক্যাপ্টেন রায়।
হঠাৎ এক ঝলক হাসি ছড়িয়ে পড়ল মণিকার মুখে। আপনি! এতদিন পর মনে পড়ল?
আপনার বুঝি রোজ মনে পড়ত?
মনে পড়ত বৈকি! কিন্তু সে কথা কি বলা যায়? স্বীকার করা যায়?
আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের কথা বাদ দিন।
আপনিও তো একবার টেলিফোন করতে পারতেন।
একবার কেন, একশো বার করতে পারি, কিন্তু আপনাকে কি পাওয়া যাবে?
আপনার জন্য, আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস।
মজা করে মণিকা। সিরিয়াসলি? নাকি রাজভবনের প্রোটোকলের মতো কথা বলছেন? বুড়ো গভর্নরের চাইতে আপনাদের সান্নিধ্য নিশ্চয়ই মোর ইন্টারেস্টিং।
ক্যাপ্টেন যে বলতে চাইছিল ওরই সান্নিধ্যে মোর ইন্টারেস্টিং, তা বঝুতে কষ্ট হল না মণিকার। হাজার হোক পঁচিশটি বসন্ত-মল্লিকার সৌরভে ভরেছে দেহ মন। তাই তো বারতা পেয়েছি মনে মনে সব নিঃশ্বাস পরশনে কিন্তু বলতে পারে না কেন বঞ্চনা কর মোরে, কেন বাঁধ অদৃশ্য ডোরে-দেখা দাও দেখা দাও দেহ মন ভরে মম নিকুঞ্জবনে।
বলতে পারে না অনেক কথাই। কিন্তু মন? মুখে শুধু বলল, সেইজন্যই তো এতদিন পর টেলিফোন করছেন। একটু থেমে আবার বলল, বাবা বলছিলেন আপনি যদি একদিন আসতেন…
শুধু আপনার বাবাই বলছিলেন?
মা তো চান আপনি রোজই আসুন।
তাই নাকি? এনিবডি এলস্?
মণিকার মুখে একটু হাসির রেখো ফুটে ওঠে। এই কিছুদিন রাজভবনে থেকেই তো বেশ পলিটিক্স শিখেছেন।
কেন বলুন তো?
এসব কথার অর্থ নেই, তাৎপর্য শুধু মনে মনে। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে হাহানা, ছড়িয়ে পড়ে তার সৌরভ।
শেষে ক্যাপ্টেন বলে, আমি তবুও একবার ঘুরে এসেছি। এবার তো আপনার একবার আসা উচিত।
আসব বৈকি। আপনি এর মধ্যে একবার আসুন। তারপর নিশ্চয়ই যাব।
ঠিক তত?
নিশ্চয়ই।
০৮. বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়ে
বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়ে রাতের অন্ধকারে। তার স্পর্শে, ভালোবাসায় ধীরে ধীরে জন্ম নেয় ফুল। রাতে অন্ধকারে এ খেলা দেখা যায় না, বোঝা যায় না, অনুভব করাও যায় না। কিন্তু ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে ফুলের মেলা।
ক্যাপ্টেন আর মণিকাও বুঝতে পারেনি। যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে, তুমি জান নাই, তুমি জান নাই, মরমে আমার ঢেলেছে তোমার গান। কোথায় লুকিয়ে ছিল এই মন? চোখের এই দীপ্তি? আঁখি-পল্লবে এই মায়াকাজল?
ডক্টর ব্যানার্জি বড় খুশি হলেন ক্যাপ্টেনকে দেখে। তোমার প্রেজেন্ট অ্যাসাইনমেন্টটা তো খুব ইন্টারেস্টিং?
হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন বলল, হ্যাঁ, তা কিছুটা।
তোমরা বুঝি এলাহাবাদের বাসিন্দা?
হ্যাঁ।
কতদিন এলাহাবাদে আছ?
বাবা ল পাশ করার পরই এলাহাবাদ যান। সেই থেকেই…
তোমার বাবা এখনও প্র্যাকটিশ করেছেন?
বছর দুই হল এলাহাবাদ হাইকোর্টের জর্জ হয়েছেন বলে…
ডক্টর ব্যানার্জি খুশি হয়ে বলেন, আই সি!
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিসেস ব্যানার্জি। বলেন, তোমার আর ভাইবোনেরা এলাহাবাদেই?
ক্যাপ্টেন মজা করে বলে, সেদিন খাওয়া-দাওয়া দেখে বুঝতে পারেননি আমিই বাড়ির একমাত্র ছেলে?
ইতিমধ্যে ডক্টর ব্যানার্জির এক পাবলিশার্স এসে হাজির হলেন এক বান্ডিল প্রফ আর কিছু কাগজপত্তর নিয়ে।
মিসেস ব্যানার্জি ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মণিকার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। একটু পরেই দীর্ঘ বিনুনির শেষে বাঁধুনী দিতে দিতে মণিকা এলো।
এইভাবে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে আর কতদিন নেগলেকট্ করবেন?
বিনুনি বাঁধা শেষ হল। বুকের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল যে বিনুনি তাকে ছুঁড়ে দিল পিছন দিকে। ঈষৎ বাঁকা চাহনি আর চোরা হাসি হাসতে হাসতে মণিকা বলে, তার মানে?
আপনি আসতে বললেন আর আপনারই পাত্তা নেই?
স্নান করতে গিয়েছিলাম। বিকেলে এক পুরনো বন্ধু আর তার স্বামী এসেছিলেন বলে গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল।
ভালই হয়েছে।
কেন বলুন তো?
ইউ লুক ভেরি ফ্রেশ।
আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল ক্যাপ্টেনের। মন বলছিল, তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা মম শূন্যগগনবিহারী।
অথবা…
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দু-খানি নয়নে।