সারাজীবন প্রফেসারি করে কাটিয়েছেন। ছেলেমেয়ে দেখলেই বক্তৃতা না দিয়ে থাকতে পারেন না।
মিসেস ব্যানার্জি আবার ড্রইংরুমে এলেন, কিরে বুলু, ছেলেটাকে খেতেটেতে দিবি নাকি শুধুই বকবক করবি?
খাওয়া-দাওয়ার পর্বটা বেশ ভালোই হল। বহুদিন পর কেন, বহু বছর পর এমন খাওয়া হল।
বাংলাদেশের বাঙালিদের খাওয়া-দাওয়ার একটা ধরন আছে। হরেক রকম ডাল, তরকারি, মাছ। তার সঙ্গে দই, মিষ্টি। মাঝে চাটনি। প্রবাসী বাঙালিরা আধিক্য বর্জন করেন কিন্তু ঠিক বাঙালিপনা ছাড়তে পারেন না। ডাল থাকে, মাছ থাকে; বাদ পড়ে তরকারি। তার বদলে হয়তো বা মাংস। চাটনি থাকলেও একটু আচার, স্যালাড, ফ্রাই, সসের মতো কিছু পাওয়া যাবে। এর ব্যতিক্রম হয় দেশ, কাল ভেদে। দক্ষিণ দেশের বাঙালিগৃহে সম্বার, চন্ডীগড়ে বাঙালিগৃহে বেসনের কাড়ি পাওয়া যায়।
যেসব বাঙালিরা দেশ-বিদেশে ঘুরে বাংলাদেশেই ফিরে আসেন, খাওয়া-দাওয়াটা তাদের ঘরেই ভালো হয়। নানারকম খাবারের আদিতে একটু সূপ, অন্তে একটু পুডিং ও এক কাপ কফিও থাকে।
আর্মি মেসে আর রাজভবনে খেয়ে খেয়ে মার হাতের রান্নার কথা ভুলেই গেছে ক্যাপ্টেন। আজ মনে পড়ল মা-র রান্নার কথা।
ক্যাপ্টেনকে খাইয়ে মিসেস ব্যানার্জি খুব খুশি। কষ্ট করে রান্না-বান্না করার পর অশ্রদ্ধা করে খেলে বড় বিরক্ত লাগে।
আমি কিন্তু অশ্রদ্ধা করে খাইনি, মাসিমা।
না বাবা। আমি তো তা বলছি না।
একটু যেন আপন মনে হয় ক্যাপ্টেনকে।
দৃষ্টিটা মণিকার দিকে ঘুরিয়ে বলেন, ওর বাবা বেশ খাওয়া-দাওয়া পছন্দ করতেন! এখন অবশ্য কিছুই খেতে পারেন না। কিন্তু এই হতভাগী মেয়েটা কিছু খায় না।
আবার একটু থামলেন। লোকে না খেলে কি রান্না-বান্না করতে ভালো লাগে?
মাসিমা, ওটা আজকালকার মেয়েদের ফ্যাশান।
এতক্ষণ মণিকা চুপ করেছিল। মা-র মোসাহেবী করছেন কেন বলুন তো?
ক্যাপ্টেন মজা করে, হোয়াট?
হাসিটা চেপে থাকলেও ইরানি ঠোঁটের কোণায় যে সামান্য ইঙ্গিতটুকু ছিল, তাতেই মণিকার সারা মুখে মিহি আভা ছড়িয়ে পড়েছিল। আর হোয়াট, হোয়াট করবেন না। লাটসাহেবের মোসাহেবী করে করে মোসাহেবী করাটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
আঃ! বুলু কি যা তা বলছিস?
দিন কতক পরে যখন মণিকার সঙ্গে দেখা হল তখন ক্যাপ্টেন বলেছিল, আপনি এখনও সেই ছোট্ট বুলবুলিই থেকে গেছেন।
কেন বলুন তো?
ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল, এখনও বেশ মিছিমিছি সুন্দর কথা বলতে পারেন।
সেই সুন্দর ইরানি ঠোঁটটা উল্টেই বলেছিল, পঁচিশ বছরের বুড়ির আবার মিছিমিছি কথা?
আপনি বুড়ি?
তবে কি? জানেন না বাঙালি মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয়?
ইউ উইল নেভার বি বুড়ি।
মণিকা ভুলতে পারেনি কথাটা। ঘরে, বাইরে, সর্বত্র প্রতিধ্বনি হয়ে কানে ভেসে আসছিল। ইউ উইল নেভার বি বুড়ি, ইউ উইল নেভার বি বুড়ি!।
ক্যাপ্টেনের দৃষ্টিটা যে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে, তা বুঝতে কষ্ট হল না মণিকার। ভালোই লাগল।
কথাটা তো ভালো লেগেছিল। এমন দৃষ্টি নিয়ে আগে কি কেউ দেখেছে? মণিকার মনে পড়ে না। জাল ফেললেই পুকুরের সব মাছ ধরা পড়ে না, পড়তে পারে না। ফসকে যায়, পালিয়ে যায়। কলেজ ইউনিভার্সিটির জীবনে মণিকাও ধরা পড়েনি। কিন্তু আজ?
মনের মধ্যে এই এখন দোলা লাগল। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সঙ্কোচ যেন এই এখন অনুভব করল মনে মনে।
কটক থেকে ডক্টর ব্যানার্জি ফিরে এলেন কদিন পর।
ওগো, ওই এ-ডি-সি ছেলেটিকে একদিন খেতে বলেছিলাম…
তাই নাকি?
বেশ ছেলেটি।
হ্যাঁ আমারও বেশ লেগেছে। ডক্টর ব্যানার্জি হাতের বইটা নামিয়ে রেখে বলেন, নিশ্চয়ই ভালো ফ্যামিলির ছেলে।
ক্যাপ্টেন রায়ের পরিবারের কোনো খবরই জানেন না মিসেস ব্যানার্জি। তবুও বললেন, তাতো বটেই।
হাসতে হাসতে ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, গভর্নরের চাইতে এ-ডি-সি-কেই তো প্রফেসার মঙের বেশি ভালো লেগেছে।
উনি ঠিকই বলেছেন।
পরে ডক্টর ব্যানার্জি মণিকাকে বলেছিলেন, হারে বুলু, আমি যখন ছিলাম না, তখনই তোর মা ওই এ-ডি-সি ছেলেটিকে খেতে বলল?
মণিকা শুধু একটু হাসল। কিছু বলল না।
আর একদিন ওকে আসতে বলিস।
মা-কে বলো। মার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে।
ডক্টর ব্যানার্জির মজা লাগে নিজের স্ত্রীর কথা শুনতে। তোর মা-র ব্যাপারই আলাদা।
এ-ডি-সি তো বেশ চালাক আছে। মাসিমা-মাসিমা করে বেশ জমিয়েছে।
প্রথম দিনই যখন মাসিমা বলেছে তখন তো তোর মা গলে গেছে।
আর্মি লাইফে একটা উত্তেজনা আছে। কাজকর্মের মাঝে অবকাশ থাকলেও অবসর নেই। কখনো নিজেকে নিয়ে, কখনো পরকে নিয়ে। কখনও বা সবাইকে নিয়ে। পরিচিত, অপরিচিত, আধা পরিচিতদের নিয়ে। কোথাও ব্যারাকে, কোথাও মেসে, কোথাও কোয়ার্টারে থেকেছে। একা একা। তবে নিঃসঙ্গ হয়নি কোনোদিন। আর্মি বা এয়ারফোর্সে কেউ নিঃসঙ্গ নয়। ওরা খায়-দায়-ঘুমোয় একসঙ্গে। নাচ-গান মদ খায় একসঙ্গে। যুদ্ধ করে একসঙ্গে। মৃত্যুর সময়ও ওরা নিঃসঙ্গ নয়। দল বেঁধে মরে ওরা।
রাজভবনে আসার পরই সুরটা পাল্টে গেল। এখানে নিজের নিজের তালে সবাই মত্ত। যারা দল বেঁধে মরতে শিখেছে, তারা যেন এখানে বেমানান। এরা এক টুকরো রুটি কাউকে দিতে পারে না, নিজেরা কে খেতে ওস্তাদ!
এতদিনের অভ্যাস, এতদিনের ট্রেনিং ভুলতে পারেননি। ধীরে ধীরে বহু দুরে সরে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি কাজ করেছেন কিন্তু কাছাকাছি আসতে পারেননি। মতের মিল হয়নি।