ডক্টর মঙের নিঃসঙ্গতার বেদনা অনুভব করত যে মণিকা, সে যেন ক্যাপ্টেন রায়ের নিঃসঙ্গতার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠল। কলকাতায় আপনার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই?
না।
এমন করে একলা থাকেন কিভাবে?
ক্যাপ্টেন কোনো জবাব দেয় না। কি জবাব দেবে? মণিকাও চুপ করে বসে বসে নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন প্রিয়হীন ক্যাপ্টেনকে দেখে আর মনে মনে অস্বস্তিবোধ করে।
কয়েক মিনিট কেটে গেল। ক্যাপ্টেন রায়ের আবার মনে পড়ে, সে এ-ডি-সি! সে রাজভবনে রয়েছে।
আই অ্যাম সরি মিস ব্যানার্জি। কতকগুলো আজেবাজে কথা বললাম বলে মনে কিছু করবেন না।
না না মনে করব কেন?
আবার কয়েকটা মুহূর্ত চুপচাপ। ক্যাপ্টেন আবার বলেন, একলা বেশ ছিলাম। দুঃখ কষ্টটা ঠিক অনুভব করতাম না। কিন্তু এই কদিন আপনার সঙ্গে আলাপ করে ঘোরাঘুরি করে নিঃসঙ্গতার বেদনাটা যেন প্রথম অনুভব করলাম।
মণিকা হাসল।
আপনি হাসছেন?
একটা কথা মনে হল।
কি কথা?
সেদিন সকালে যখন আপনাকে প্রথম দেখি তখন ভাবতে পারিনি আপনি এত লোনলি! আপনার হাসিখুশি ভরা মুখ আর স্মার্ট ব্যবহার দেখে ভেবেছিলাম ইউ আর দি হ্যাপিয়েস্ট ম্যান ইন দিস ওয়ার্লড।
ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে দুটো লাইন আবৃত্তি করলেন, The wind blows out of the gates of the day, the wind blows over the lonely of heart…0.378 TROSTRI CHOYT হাওয়া…
ক্যাপ্টেন আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু মণিকা বাধা দিল, আপনি তত বেশ মজার লোক।
কেন বলুন তো?
ইয়েটসকেও মুখস্থ রেখেছেন?
ক্যাপ্টেন কোনো কথা না বলে সামনের সেন্টার টেবিলে রাখা সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে তুলে নেয়। লাইটারটাও হাতে তুলেছিল কিন্তু মণিকা হাত থেকে নিয়ে নিল, আমি জ্বালিয়ে দিচ্ছি।
মণিকা লাইটার জ্বালতেই ক্যাপ্টেন সিগারেট ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ধন্যবাদ।
কিছু ধন্যবাদ দিতে হবে না। এটা আমার হ্যাঁবিট হয়ে গেছে। ডক্টর মঙ চুরুট তুললেই আমি লাইটার জ্বেলে ধরতাম।
Lord, lift thou up the light of thy countenance upon us.
মণিকা হাসতে হাসতে বলে, আই উইস আই ওয়াজ ইওর লর্ড!
এই অন্ধকারে যখন একবার আলো জ্বালিয়েছেন, তখন লর্ড না বলে অস্বীকার করতে পারি?
.
মণিকার সঙ্গে এই ভাবেই আলাপ। আরো অনেক মেয়ের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে। নানা জায়গায়, নানা ভাবে। আম্বালা ক্যান্টে থাকার সময় দুর্গাপুজো নিয়ে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল মনীষার সঙ্গে। জীপে চড়ে সারা ক্যান্টনমেন্ট ঘুরেছে দিনের পর দিন, চাদা তুলেছে প্রতিটি কোয়ার্টার থেকে। বিজয়ার দিন মা দুর্গার স্বামীর ঘর করতে চলে যাবার পরও সে সম্পর্ক হারিয়ে যায়নি। হায়দ্রবাদে থাকার সময় বাঙালিদের নববর্ষ উৎসবে আলাপ হয়েছিল সীমার সঙ্গে। আরো কত জনের সঙ্গে এমনি আলাপ হয়েছে। কিন্তু এবারের সুর যেন আলাদা। স্বতন্ত্র। হয়তো বা অনন্য।
ক্যাপ্টেন রায়ের বার বার মনে হল মণিকা চলে গেলেও কি যেন রেখে গেছে, কি যেন নিয়ে গেছে। সব কিছু ঠিক ছিল, কিন্তু তবুও যেন একটা লেনদেন হয়ে গেছে দুজনেরই অজ্ঞাতসারে।
দিনগুলো শুরু হতো, শেষ হতো ঠিক আগেরই মতো। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়েই খবরের কাগজে লাটসাহেবের ছবি দেখা, আমজাদের দেওয়া ব্রেকফাস্ট খাওয়া, তাড়াহুড়ো করে ইউনিফর্ম চেক করা, হাতে স্যাফরন কলারের আর্ম ব্যাচ পরা থেকে শুরু করে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার মুখে লর্ড ওয়েলেসলীর বিরাট পেন্টিংটার সামনে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, গুডমর্নিং লর্ড!
ঘড়ির কাঁটার মতো সব কিছুই আগের মতো চলছিল। কিন্তু তবুও কেমন ব্যতিক্রম মনে হচ্ছিল ক্যাপ্টেনের। অফিস ঘরের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে যে ক্যাপ্টেন শুধু দুরের ফুলের মেলা দেখতেন, সেই ক্যাপ্টেন টিউলিপ বা লিলির গোছা নিয়ে নিজের ঘরে রাখতে শুরু করলেন। টিউলিপ লিলির বিনষ সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে হয়তো মণিকাকে দেখতেন।
একে আর্মি অফিসার তার উপর লাটসাহেবের এ-ডি-সি। ভদ্রতা, সৌন্দর্য শৃঙ্খল দিয়ে মনকে বন্দী করতে চেষ্টা করতেন সর্বদা। টেলিফোন ডাইরেক্টরীতে ডক্টর ব্যানার্জির নাম্বারের পাশে লাল পেন্সিসের নিশানা দিয়েছিল কিন্তু তবুও ডায়াল ঘোরাতে পারেনি।
ডিউটির পর একলা একলা চুপচাপ শুয়ে থাকে নিজের ঘরে। মোরাভিয়াকে পড়তেও ঠিক মন বসে না।
দুদিনের জন্য লাটসাহেবের সঙ্গে মেদিনীপুর ঘুরে এলেন। সেদিন গভর্নরের বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। শুধু বিকেলে কাউন্সিল চেম্বারে স্টেট লেপ্রসি বোর্ডের একটা মিটিং ছিল। ডিউটিতে ছিল লেফটেন্যান্ট ধীলন। ক্যাপ্টেনের অফছিল। দুপুরে ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়েছিলেন এক বন্ধুর সঙ্গে লাঞ্চ খেতে। ফিরে এলেন প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ। শুয়ে শুয়ে বইবত্তর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল টেলিফোনের জন্য।…ইয়েস ক্যাপ্টেন রায়…।
গলাটা শুনেই চমকে উঠলেন, কে?
আমি মণিকা ব্যানার্জি বলছি।
মণিকা দেখতে পেল না ক্যাপ্টেন আনন্দে লাফিয়ে উঠে বসলেন। বলুন কেমন আছেন?
মেদিনীপুর থেকে ঘুরে এলেন?
আপনি জানলেন কেমন করে?
কেমন করে আবার! খবরের কাগজে ছবি দেখে।
রিয়েলি?
তবে কি ঠাট্টা করছি?
আরো কি যেন বলে দুজনেই। তারপর মণিকা বলল, ডক্টর আপনার খুব প্রশংসা করে চিঠি লিখেছেন।