সে রাত্রে বিদায় নেবার সময় ডক্টর আর মিসেস ব্যানার্জি দুজনেই বলেছিলেন, সময় পেলেই চলে এসো।
নিশ্চয়ই।
পরের দিন সকালে অধ্যাপক মঙ বেনারস চলে গেলেন। এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে অনেকেই এসেছিলেন। ডক্টর ব্যানার্জি আর মণিকাও এসেছিল। ডক্টর ব্যানার্জি ভাইস চ্যান্সেলার ডক্টর সেনগুপ্তের সঙ্গে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন রায় মণিকাকে বললেন, যদি আপত্তি না থাকে তো আমার আস্তানায় এক কাপ কফি খেয়ে যান।
রাজভবনের গাড়িতে ক্যাপ্টেন রায় আর মণিকা রওনা হল গভর্নমেন্ট হাউসের দিকে।
০৭. রাজভবনের পোর্টিকোতে গাড়ি
রাজভবনের পোর্টিকোতে গাড়ি থামতেই তকমা আঁটা বেয়ারা এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। এ-ডি-সি সাহেবের সঙ্গে মণিকাকে দেখে মার্বেল হলের এপাশে ওপাশে যে সব বেয়ারারা ছিল, তারা সবাই একটু অবাক হল। আগে কোনো কোনো এ-ডি-সি-কে ওরা গার্ল নিয়ে আসতে দেখেছে, কিন্তু ক্যাপ্টেন রায় কোনোদিন কাউকে নিয়ে আসেননি।
আশপাশের বেয়ারারা মুখে কিছু বলল না, বলতে পারে না, শুধু সেলাম দিল।
লিফটম্যানও সেলাম দিয়ে উপরে নিয়ে গেল। করিডোরের বেয়ারারাও সেলাম দিল। সেলাম কুড়ুতে কুড়ুতে ক্যাপ্টেন রায় মণিকাকে নিয়ে নিজের ঘরের দরজায় এলেন। সেখানেও একটা বেয়ারা সেলাম দিয়ে দরজা খুলে দিল।
ক্যাপ্টেন রায় মাথার টুপিটা খুলে সসম্ভ্রমে দরজা দেখিয়ে বললেন, প্লিজ।
একটু মুচকি হেসে মণিকা ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল, এখানে কিভাবে থাকেন বলুন তো?
কেন বলুন তো? আমার ঘরটা কি এত খারাপ?
চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে মণিকা বলে, আপনার ঘরের কথা বলছি না বলছি এই রাজভবনের কথা।
অবাক হয় ক্যাপ্টেন রায়, রাজভবনের আবার কী হল।
একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মণিকা আবার বলে, মাই গড! সে বোধশক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন?
এক্সকিউজ মি…
মণিকা নিজের মুখের সামনে একটা আঙুল তুলে বললে, এই ফর্মালিটিগুলো ছেড়ে কথা বলতে পারেন না?
অনেকটা নিশ্চিন্তবোধ করে ক্যাপ্টেন রায়। দুএক পা এগিয়ে এসে একটা কৌচের টুপিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, বাট হোয়াট হ্যাঁপেনড় টু রাজভবন?
প্রাণহীন পুতুলের মতো এই লোকগুলোর সেলাম নিতে বুঝি আপনার খুব ভালো লাগে?
ক্যাপ্টেন রায় এবার হেসে ফেলে। প্লিজ হ্যাঁভ ইওর সিট…
আবার প্লিজ?
আই অ্যাম সরি।
শুধু দুঃখ প্রকাশ করলেই চলবে না। প্রতিজ্ঞা করুন আমার সঙ্গে ওই ধরনের ফর্মাল কথাবার্তা বলবেন না।
ক্যাপ্টেন রায় যেন হঠাৎ একটু দুষ্টুমি করে একটু চাপা গলায় জানতে চায়, যদি বেশি ইনফর্মাল হই?
মণিকা এবার ব্রেক করে, আপনি আমাকে কফি খাওয়াবেন বলে এখানে এনেছেন। সেকথা। মনে আছে কি?
আই অ্যাম সরি…
ক্যাপ্টেন রায় বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে তলব করল। আমজাদ আভি ডিউটিমে হ্যায়?
হ্যাঁ সাব।
পাঠিয়ে দাও তো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমজাদ এসে দুজনকেই সেলাম দিল।
আমজাদ, এই মেমসাহেব আমার পয়লা মেহমান। একটু ভালো করে কফি-টফি খাওয়াবে?
জরুর।
তাহলে জলদি লে আও।
এতকাল রাজভবনে কাজ করে মেহমানের মর্যাদা বোঝে আমজাদ আলি। তাইতো, শুধু কফি আনেনি, এনেছিল ডবল ডিমের ওমলেট, কেক, পেস্ট্রি, ক্যাসুনাটস ও আরো কি যেন।
মণিকা ঘাড় বাঁকা করে ক্যাপ্টেন রায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি কি ভেবেছেন বলুন তো?
কেন? কি হল আবার?
সামনে ট্রে দেখেও বুঝতে পারছেন না কি হল?
হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন রায় বলে, আই সি। কিন্তু আমি জানতাম বার্মিজ মেয়েরা বেশ খেতে পারে।
হোয়াট ডু ইউ মিন?
না, না, আমি কিছু মিন করছি না তবে…
তবে-টবে ছাড়ুন। এক কাপ কফি খাওয়াতে এনে যা ইচ্ছে তাই বলে যাবেন?
কেন যে অহেতুক দুজনে তর্ক করল, তা ওরা কেউ জানে না। মনে যখন ঝঙ্কার লাগে, দূর থেকে যখন একটা অস্পষ্ট স্বপ্ন উঁকি দেয়, তখন বোধহয় এমনি হয়। সবারই হয়। ক্যাপ্টেন-মণিকার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটল না।
ক্যাপ্টেন সকালে শুধু এক কাপ চা খেয়েই এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। বেশ খিদে লেগেছিল।
আপনি ভদ্রতা করলেও করতে পারেন; আমার কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছে।
নিশ্চয়ই। বলে নিজেই ক্যাপ্টেনকে খাবার-দাবার এগিয়ে দিল। নিজেও দুচারটে নাটস মুখে দিল।
ক্যাপ্টেন নিজেই কফি করতে হাত বাড়ালে মণিকা বাধা দিল। থাক, থাক। আমি থাকতে আপনাকে আর নিজে হাতে কফি তৈরি করতে হবে না।
আই অ্যাম এক্সট্রিমলি গ্রেটফুল ফর দি কাইন্ড কন্সিডারেশন।
আবার ভদ্রতা? অত ভদ্রতা করলে এক্ষুনি চলে যাব।
অভদ্রতা করলে অনেকক্ষণ থাকবেন? চাপা হাসি হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন রায় জানতে চান।
মণিকাও হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ভদ্রতা-অভদ্রতা কিছুই করতে হবে না! স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলুন। একটু গল্পগুজব করেই পালাই।
ক্যাপ্টেন যেন উদ্বিগ্ন হয়, এক্ষুনি যাবেন?
যাব না?
ক্যাপ্টেন একটু আনমনা হয়। কৌচ থেকে উঠে একবার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কোনো সুদূরের দিকে একবার দেখে নেয়। প্যান্টের পকেটে দুটো হাত পুরে ধীরে ধীরে ফিরে আসে মণিকার দিকে।
জানেন মিস ব্যানার্জি, কলকাতায় আসার পর আপনিই আমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড অ্যান্ড ফার্স্ট গেস্ট।
মণিকা যেন আঘাত পেল তার দরদী মনে। কেন, এখানে আপনার কেউ নেই?
না।
সময় কাটান কিভাবে?
সময়? রাজভবনের শাসন অমান্য করেই ক্যাপ্টেন রায়ের একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। ডিউটির পর চুপচাপ শুয়ে শুয়ে বইপত্তর পড়ি, নয়তো এই বেয়ারা-চাপরাশিদের সঙ্গে গল্পগুজব করি।