অধ্যাপক মঙ মণিকাকে বলতেন, মাই সুইট লিটল মাদার।
পরে এই বৃদ্ধের আগ্রহেই মণিকা রেঙ্গুনে এম-এ পড়ে।
অধ্যাপক ডক্টর ব্যানার্জিকে আরো দুবছর রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখেছিলেন শুধু মণিকার জন্য। এম-এ পাশ করার পর সবাই চলে এলেন কলকাতা।
ব্যানার্জি পরিবার কলকাতা চলে এলেও ভুলতে পারলেন না স্নেহাতুর বৃদ্ধ অধ্যাপক মঙকে। আর মণিকা? সে তো সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না তার এই বৃদ্ধ সন্তানকে। বিপত্নীক অধ্যাপক মঙের একমাত্র পুত্র-উ থান একেবারে উত্তরে কাচিনে হীরার কারখানায় কাজ করত। বছরে একবারের বেশি ছুটি পেত না। পুরনো দুটি কর্মচারী ছাড়া বৃদ্ধকে দেখার কেউ ছিল না। মণিকা মনে মনে বড় দুঃখ পেত বৃদ্ধের কথা ভেবে। তাইতো বড় বেশি জড়িয়ে পড়েছিল বৃদ্ধের সঙ্গে।
বিকালবেলায় দুজনে মিলে বেড়াতে যেতেন। কোনোদিন গোল্ডেন প্যাগোডায় বা ইনিয়া লেকের ধারে। অথবা অন্য কোথাও। কত কথা হতো দুজনের।
আচ্ছা আংকেল, আপনার ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
মণিকা জানতে চাইতো।
বৃদ্ধ হাসতে হাসতে জবাব দেন, ঠিক বলেছ মা। একবার একটি মেয়ে পছন্দও হয়েছিল কিন্তু মেয়েটির জন্মবার নিয়েই গণ্ডগোল হল।
অবাক হয় মণিকা, তার মানে?
বুঝলে তোমাদের মতো আমাদের বিয়েরও কতকগুলো নিয়ম-কানুন আছে। ছেলেমেয়ের জন্মবার এক হলে আমাদের বিয়ে হয় না।
তাই নাকি?
থানানের জন্ম সোমবার। মেয়েটিও সোমবারে জন্মেছে। তাই…
আরো তো মেয়ে আছে।
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, আছে বৈকি মা। তবে বিয়ে-টিয়ে কি চটপট হবার জিনিস?
মণিকা তবুও থামে না। কিন্তু আপনি কতকাল এমনি একলা একলা কাটাবেন?
ইনিয়া লেকের জলে হয়তো মুহূর্তের জন্য নিজের অদৃষ্টের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। সব মেয়েই যে তোমার মতো আমার কথা ভাববে তার কি মনে আছে?
না, না, ওকি কথা বলছেন? তাছাড়া নাতি-নাতনি তো আপনার কাছে থাকতে পারবে।
অত শত আমি আশা করি না। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ নিরাশক্তের মতো জবাব দেন।
গোন্ডেন প্যাগোডার ধারে বেড়াতে বেড়াতে কোনো কোনোদিন বৃদ্ধ বলেন, তার চাইতে তুমি বিয়ে কর। আমি কলকাতায় তোমার কাছেই থাকব আর মাঝে মাঝে একটু বোদ্ধগয়া ঘুরে আসব।
বৃদ্ধের সঙ্গে মণিকার সম্পর্কই আলাদা। আমার স্বামী যদি খারাপ হয়?
মণিকার মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মঙ বললেন, এই বুঝি দুষ্টুমি শুরু হল?
এই অধ্যাপক মঙ আর মণিকাকে নিয়ে তিনটি দিন ক্যাপ্টেন রায়ের বড় আনন্দে কেটেছিল।
ক্যাপ্টেন, ইউ উইল নেভার ফাইন্ড এ বেটার গার্ল দ্যান মণিকা। বৃদ্ধ যেন একটু গর্ব অনুভব করেন মণিকার কথা বলতে। আত্ম তৃপ্তিভরা হাসি মুখে একবার মণিকাকে দেখে নিয়ে বলেন, লেখাপড়ায় যদি আর একটু ভালো হতো…
মণিকা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল বলে বুড়োর মনে বড় দুঃখ।
…গান বাজনা আর সংসারের প্রতি এত আকর্ষণ হলে কি লেখাপড়া হয়?
বৃদ্ধ প্রশ্ন করেন ক্যাপ্টেন রায়কে।
ক্যাপ্টেন রায় এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে? কথার মোড় ঘোরাবার জন্য মণিকার দিকে ফিরে বলে, একদিন গান শোনাবেন তো?
বৃদ্ধ গর্জে ওঠেন, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই শোনাবেন তো? আজ ইভনিং…এ-ই এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ফিরে এলে গান হবে।
পাশের কৌচে মুখ নিচু করে বসে থাকে মণিকা।
বৃদ্ধের প্রস্তাবে খুশি হয় ক্যাপ্টেন রায়, খুব ভালো হবে।
বাট…। বৃদ্ধ যেন কোথায় খটকা বোধ করলেন।
ক্যাপ্টেন আর মণিকা একসঙ্গেই বৃদ্ধের দিকে তাকায়।
তোমাদের এই রাজভবনে ঠিক জমবে না। তার চাইতে অন্য কোথাও…
এশিয়াটিক সোসাইটিতে অধ্যাপক মঙের সম্বর্ধনা সভা শেষ হবার পর সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনজনে চলে গিয়েছিল শহর থেকে দূরে।
বৃদ্ধ বলেছিলেন, শুরু কর মা, সময় নষ্ট করো না।
মণিকা জানতে চাইল, শুধু গীতাঞ্জলির গান?
একশো বার!
একের পর এক গান শুনিয়েছিল মণিকা।
গান শুনতে শুনতে বিভোর হয়েছিলেন অধ্যাপক মঙ। বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে এলে বললেন, ওনলি এ সঙ, ফিলসফার লাইক টেগোর ক্যান রাইট দিস। এমন করে আত্মসমর্পণ আর কে করতে পারে?
কলকাতা ফেরার পথে অধ্যাপক এ-ডি-সি-কে বলেছিলেন, শুধু গভর্নমেন্ট হাউসের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রেখো না। মাঝে মাঝে আমার মায়ের কাছে গিয়ে গান শুনে এসো।
এক ঝলক মণিকাকে দেখে নিয়ে ক্যাপ্টেন রায় বলেছিলেন, স্যার আপনি চলে গেলে কি উনি চিনতে পারবেন?
এবার আর মণিকা চুপ করে থাকেনি, বরং আপনিই চিনতে পারবেন না। গভর্নমেন্ট হাউসে থেকে কি আমাদের মতো সাধারণ মেয়েদের মনে রাখা সম্ভব?
তাই নাকি?
অধ্যাপক মঙের কলকাতা ত্যাগের পূর্বসন্ধ্যায় ব্যানার্জিগৃহে ক্যাপ্টেন রায়ের প্রথম পদার্পণ হয়। সে সন্ধ্যায় বাইরের বিশেষ কেউ ছিলেন না। শুধু তরুণ বার্মিজ কলাল জেনারেল এসেছিলেন, সরকারি পদমর্যাদার জন্য নয় ডক্টর ব্যানার্জির ছাত্র হিসেবে। ভাত মাছ তরকারি রান্না করেছিলেন মণিকার মা। মণিকা রান্না করেছিল মঙের প্রিয় মহিঙ্গা।
ক্যাপ্টেন রায় অবাক হয়েছিলেন, আপনি বার্মিজ রান্নাও জানেন?
এই একটু আধটু।
মণিকার মা বললেন, আমি এতদিন রেঙ্গুনে থেকেও শিখতে পারলাম না অথচ মণিকা… খেতে খেতে হঠাৎ থেমে গেলেন অধ্যাপক মঙ, গতজন্মে ও বার্মিজ ছিল।
ক্যাপ্টেন রায় হাসতে হাসতে বলেন, মনে হয় আপনার কথাই ঠিক।