এসব নোংরামি ঘাঁটাঘাঁটি করতে ক্যাপ্টেন রায় উৎসাহবোধ করেন না। হেডক্লার্ক মজুমদার বাবুকে তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি তবুও কানে ভেসে এসেছে অনেক কাহিনি।
ভি-আই-পি-দের নামে স্পেশাল সেক্রেটারি বা ডেপুটি সেক্রেটারিরও উপরি পাওনা নেহাত মন্দ হয় না। ফরেন ভি আই পি এলে প্রতিটি গেস্টের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয় ইমপোর্টেড ওয়াইন বা অ্যালকোহলের বোতল। সবাই মদ খান না; খেলেও এক বোতল কেউই খান না, খেতে পারেন না। পরের দিন সকালে পুরুত ঠাকুর ডেপুটি-স্পেশাল সেক্রেটারির বাড়িতে পৌঁছে যায় এই বোতল বোতল নৈবেদ্য। সীল ভাঙা বোতল তো আর কোনো গেস্টকে দেওয়া যায় না।
ক্যাপ্টেন রায় এসব জানতেন না। একবার আমজাদ আলি এক বোতল স্কচ পৌঁছে দেয় ওর ঘরে। হঠাৎ এক বোতল স্কচ পেয়ে মনটা আনন্দিত হলেও বিস্মিত হয়েছিলেন।
কি ব্যাপার? স্কচের বোতল?
জি হ্যাঁ সাব। এটা আপনার।
বোতলটা হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করতে করতে এ-ডি-সি সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, টাকা দিতে হবে না?
নেহি সাব। টাকা পয়সা দিতে হবে না।
গভর্নর সাব পাঠিয়েছেন?
এবার আমজাদ হেসে ফেলে, না সাব লাটসাব কি শরাব পাঠাতে পারেন?
তবে?
আমজাদ আর চেপে রাখতে পারেনি। গড় গড় করে সব বলেছিল।
বোতলটা ফেরত দিয়ে সাহেবকে আমার সেলাম দিও।
পরে একদিন আমজাদকে বলেছিলেন, একটু আধটু ড্রিংক করি বটে তবে বিনা পয়সায় নয়। আর্মি অফিসারদের কাছে মদ জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ নয়। দরকার হলে আমি ফোর্ট উইলিয়াম ক্যান্টিন থেকেই আনতে পারব।
ওই ঘোড়ার আস্তাবল বা মোটর গ্যারেজের উপরে যে অফিসারগুলো থাকে, তাদের মনোবৃত্তি যে কেমন বিচিত্র হয়!
যাকগে ওসব। রাজভবনে তো শুধু ভি-ভি-আই-পি-রাই থাকেন না, আরো অনেকে থাকেন। এখানে এক অতিথির আগমন হয়েছিল বলেই তো মণিকার সঙ্গে ক্যাপ্টেন রায়ের প্রথম আলাপ হয়।
ক্যাপ্টেন কমল রায়ের মানসী, মণিমালা মণিকা ব্যানার্জি।
…রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটির রেক্টর উ মঙ এলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ দিতে। বার্মার সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে রাস্ত্রীয় অতিথি হবার সাদর আমন্ত্রণ জানান। উ ম সানন্দে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তারপর মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ মতো পশ্চিমবাংলার গভর্নর তাকে তিনদিনের জন্য শক্তিগত অতিথি হবার অনুরোধ জানান।
এসব ক্যাপ্টেন রায় জানতেন। উ মঙকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়েছিলেন ওর সহকর্মী। পরের দিন সকালে গভর্নরের সঙ্গে উ মঙের সৌজন্য সাক্ষাৎকার করার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন রায়ের। যেসব অতিথিদের সঙ্গে প্রাইভেট সেক্রেটারি থাকেন না, তাদের এনগেজমেন্ট প্রোগ্রাম সম্পর্কে এ-ডি-সিদের একটু খেয়াল রাখতে হয়।
আমজাদের ব্রেকফাস্ট খেয়ে, সিঁড়ির মুখে লর্ড ওয়েলেসলীর পেন্টিং-এর সামনে থমকে দাঁড়িয়ে ভক্তি জানিয়ে ক্যাপ্টেন রায় ঠিক আটটায় গভর্নরকে সেলাম জানাতে গেলেন।
প্লিজ লুকআফটার প্রফেসর মঙ। হাজার হোক বৃদ্ধ মানুষ, তারপর সাহায্য করার কেউ নেই।
মাথা নিচু করে এ-ডি-সি জানান, সার্টেনলি স্যার।
ইফ দেয়ার ইজ নো আদার সিরিয়াস ওয়ার্ক তাহলে এই তিনদিন তুমি ওর সঙ্গে সঙ্গে একটু থেকো।
পারফেক্টলি অল রাইট, স্যার! আমি তিনদিনই ওর সঙ্গে থাকব।
গভর্নরের প্রস্তাবে ক্যাপ্টেন খুশিই হন! এসব গেস্টদের দেখাশুনা করতে কোনো ঝামেলা নেই। গভর্নরের সঙ্গে ওর দেখা করার কথা পৌনে নটায়! তবুও সওয়া আটটা বাজতে না বাজতেই ক্যাপ্টেন রায় প্রফেসর মঙের দরজায় নক করলেন।
মিনিট খানেক পরে যিনি দরজা খুলে দিলেন, ঠিক মহিলাও নন, একজন যুবতী। সাধারণ ভারতীয় মেয়েদের মতো শাড়ি পরা মেয়ে। দেখে অধ্যাপক মঙের স্ত্রী বা মেয়ে বলেও মনে হল না।
তবে?
মনের দ্বিধা মনেই রাখলাম! গুডমর্নিং।
আই অ্যাম ক্যাপ্টেন রয়, এ-ডিসি টু দ্য গভর্নর।
বিচিত্র ঔৎসুক্যভরা সলজ্জ দৃষ্টি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে এ-ডি-সি-কে দেখে নেবার পর উনি বলেছিলেন, গুডমর্নিং!
তারপর মিষ্টি গলায় শুদ্ধ বাংলায়, আসুন ভিতরে আসুন।
বাচালতা, চপলতা এ-ডি-সি-র জন্য নয়। মুখে কিছু বলেননি ক্যাপ্টেন রায়। তবে মুচকি হেসে ভালো করে একবার দেখেছিলেন তার ভবিষ্যৎ জীবন-সম্রাজ্ঞীকে।
সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ অধ্যাপক বড় কৌচের একপাশে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
এক্সকিউজ মি স্যার, আমি গভর্নরের এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রয়।
কাম অন অফিসার, এদিকে বসো।
সম্মানিত অতিথিদের পাশে বসার বাধা না থাকলেও চলন নেই। ক্যাপ্টেন রায় সঙ্কোচের সঙ্গে সকৃতজ্ঞ হয়ে ধন্যবাদ জানালেন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!
মণিকার বেশ লাগছিল। কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ।
গোল গোল রূপোর ফ্রেমের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধও একটু সকৌতুক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন ক্যাপ্টেন রায়কে।
.
তিনটি দিন বেশ কেটেছিল। ক্যাপ্টেন রায়ের স্মৃতিতে অমর অক্ষয় হয়ে রয়েছে ওই তিনটি অবিস্মরণীয় দিনের কথা, কাহিনি।
অধ্যাপক মঙ যখন রেঙ্গুনে ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার, মণিকার বাবা ডক্টর ব্যানার্জি তখন ওখানে ভিজিটিং প্রফেসর হয়েছিলেন দুবছরের জন্য। মণিকা তখন ভিক্টোরিয়াতে বি-এ পড়ে। একমাত্র সন্তান হয়েও বাবা-মার সঙ্গে রেঙ্গুনে যেতে পারেনি। হোস্টেলেই থাকত। ছুটিতে রেঙ্গুনে যেতো।