আমজাদের সঙ্গে সারাদিনে আর দেখা হবেনা। রোজ সকালে মেসিনের মতো তিনবার আমজাদ আসে এ-ডি-সি সাহেবের ঘরে। সাড়ে ছটায় ছোট্ট এক পট চা আর একটা সিঙ্গাপুরী কলা নিয়ে। ওই বেড-টি দেবার সময়ই কলকাতার মর্নিং পেপারগুলো নিয়ে আসে আমজাদ। আমজাদই চা তৈরি করে। আর সেই ফাঁকে এ-ডি-সি সাহেব চোখ বুলিয়ে নেন খবরের কাগজগুলোতে।
আর দেরি করেন না ক্যাপ্টেন রায়। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে করিডোরে দিতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান লর্ড ওয়েলেসলীর ওই বিরাট পেন্টিংটার সামনে। ওই মুহূর্তের মধ্যেই ক্যাপ্টেন শ্রদ্ধা জানান ওই মহাপুরুষকে যাকে ইংরেজরা ঠাট্টা করে বলত Sultanized Englishman. ইংরেজ হয়েও যিনি সুলতানের মতো প্রমত্ত থাকতে ভালোবাসতেন-যিনি লালকেল্লা-কুতব-মিনার-তাজমহল তৈরি না করলেও ডালহৌসী পাড়ায় লাটসাহেবের ওই প্রাসাদ তৈরি করেছেন, তাকে বড় ভালো লাগে ক্যাপ্টেন রায়ের। ইতিহাসের পাতায় লর্ড ওয়েলেসলীর নাম লেখা থাকলেও ভারতের মানুষ তাকে ভুলে গেছে। আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকরা হয়তো নানা অপকীর্তির জন্য লর্ড ওয়েলেসলীর বিদেহী আত্মাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, কিন্তু গভর্নর থেকে শুরু করে রাজভবনের জমাদার পর্যন্ত তাকে লুকিয়ে শ্রদ্ধা করবেই। ক্যাপ্টেন রায় তো তাই ডিউটিতে যাবার আগে ওয়েলেসলীর ওই পেন্টিংটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারেন না।
এগজ্যাক্টলি অন্ দি ডট! কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায় আধ ডজন বেয়ারার সেলাম নিতে নিতে অফিসে হাজির। লাটসাহেবের ছাপান প্রোগ্রাম সামনেই রয়েছে।
ছাপান প্রোগ্রাম?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছাপান। সোস্যালিস্ট ভারতবর্ষের নাবালক সংবিধানের সাবালক অভিভাবককে কি টাইপ করা কাগজে ডেইলি এনগেজমেন্ট দেখান যায়?
সাধারণত সাড়ে আটটা নাগাদই লাটসাহেবও নিজের অফিসে আসেন। সারা দিনের কাজকর্ম নিয়ে এ-ডি-সি ও সেক্রেটারির সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলেন। তারপর তিনি ভিজিটার্সদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেন।
…লাটসাহেবের দপ্তরের দুটি ভাগ। সেক্রেটারি টু দি গভর্নরই সর্বেসর্বা। তবে সাধারণত তিনি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে গভর্নরের যোগসূত্র রক্ষা করেন বা তদারক করেন। প্রতিদিন বেশ কিছু সরকারি ফাইলে ও নথিপত্রে গভর্নরকে অটোগ্রাফ দিতে হয়। ঠিক টপ সিক্রেট কাগজপত্র কিছু নয়। অধিকাংশই মামুলি ধরনের আর আসে ক্যাবিনেটের কাগজপত্তর। মন্ত্রীদের ফরমায়েস মতো চীফ সেক্রেটারি বা হোম সেক্রেটারি মারফত যে সব ফাইলের বাণ্ডিল আসে গভর্নরের সেক্রেটারির কাছে, চটপট গভর্নরকে দিয়ে সই করিয়ে সে-সব ফাইল ফেরত পাঠানই সেক্রেটারির প্রধানতম কাজ। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেও টুকটাক চিঠিপত্র আসে। সে-সবের সদগতি করাও ওই সেক্রেটারি সাহেবেরই কাজ।
রাজভবনের দেখাশুনা, অতিথি আপ্যায়ন, সরকারি অতিথিশালা পরিচালনা, গভর্নরের ভ্রমণসূচী ঠিক করা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা ইত্যাদি সব কাজই আগে দেখাশুনা করতে মিলিটারি সেক্রেটারি। ওটা ইংরেজ আমলের নিয়ম ছিল। বীরপুরুষ ইংরেজ যেকালে মনে করত সব ইন্ডিয়ানদের পকেটেই একটা রিভলভার থাকে, সেকালে মিলিটারি সেক্রেটারি ছাড়া ও সব দায়িত্বকে বহন করতে পারত? জমানা বদল গয়া। এখন একজন মামুলী ধরনের ডেপুটি সেক্রেটারি, মিলিটারি সেক্রেটারির কাজ করেন। সাধারণত যেসব অফিসারকে দিয়ে সেক্রেটারিয়েটের দায়িত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই অথচ ফালতু মাতব্বরী করতে শিরোমণি, তাদেরই পাঠান হয় রাজভবনে।
রাজভবনে পোস্টিং পাওয়া অবশ্য শাপে বর। যাগগে সেসব কথা।
এ-ডি-সি-দের কাজ হচ্ছে গভর্নরের খিদমদগারি করা। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যাধ্যক্ষের হুকুম যারা তামিল করেন, তাদেরই বলা হতো এইড-ডি-ক্যাম্প। জাপানের সম্রাট, রাশিয়া বা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এ-ডি-সি নেই কিন্তু আমাদের গভর্নরদের তিন তিনজন করে এ-ডি-সি থাকে। আশে পাশে কিছু মোসাহেব বা খিদমার ভ্রমরের মতো গুঞ্জন না করলে জমিদার ইংরেজ ঠিক শান্তি পায় না। নিজের দেশে বৌ বাসন মাজবে, কাপড় কাঁচবে, নিজে গাড়ি চালাবে কিন্তু জমিদারিতে এলেই সব ঠুটো জগন্নাথ। তখন কথায় কথায় সেলাম চাই, সেক্রেটারি চাই, সোফার চাই, আয়া চাই, কুক চাই, চাই এ-ডি-সি আর কত কি!
বেশ লাগে দেখতে। হঠাৎ দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এরা রাষ্ট্রপতি ভবন বা রাজভবনের বেয়ারা, চাপরাশী, অর্ডালী বা অন্য কিছু। মনে হবে চিৎপুরের যাত্রা পার্টির মীরমদন, মীরকাশিম বা সিরাজের সৈন্যবাহিনীর অন্য কেউ।
ডালহৌসী পাড়ায় বাঙালির ছেলেরা বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে মুখের গ্রাসের জন্য দিবারাত্র সংগ্রাম করছে। জীবন-সংগ্রামের এই অকূল সমুদ্রের মাঝখানে রাজভবন একটি ছোট্ট দ্বীপ। অমরাবতী, অলকানন্দা। ক্লাইভ, কার্জন, ডালহৌসীর আত্মা যেন ওখানে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মীরমদন, মীরকাশিমের দল তাদের খিদমারী করছে।
ক্যাপ্টেন রায়ের বেশ মজা লাগে। ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ওই ব্যারাকের জীবন থেকে রাজভবন। এ যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। বেগম নেই, বাদশা নেই, সন্ধ্যাবেলায় নর্তকীর। ঘুঙুরের আওয়াজ নেই, নেই সেতারে দরবারি কানাড়া ও মেঘমল্লারের ঝঙ্কার কিন্তু তবু এ যেন বিংশ শতাব্দীর অচিন দেশ!…