জেফারসন চিৎকার করে বলতেন, গেট আউট রাডি বাগার।
ডরোথি বলত, রাডি জেফারসন ডোন্ট সাউট। গিভ হিম ড্রি।
রমজান আর এক মুহূর্ত দেরি করত না। ভয়ে চটপট পালিয়ে যেত ঘর থেকে।
এবার রমজান টেলিফোন করত গভর্নমেন্ট হাউসের পুলিশ অফিসে। হিজ এক্সেলেন্দীর মেয়েরা এখন যাবেন না। এখনও ওরা ঘরের মধ্যেই আছেন।
রাত এগারোটার পর আধ ঘণ্টা অন্তর রমজানকে খবর দিতে হতো গভর্নমেন্ট হাউসে। প্রয়োজনবোধে পুলিশ অফিস সতর্কতা অবলম্বন করত। হাজার হোক অ্যান্ডারসন সাহেবের মেয়ে তো। বাপের পাপে মেয়েদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে কিনা কে বলতে পারত?
বারোটা নাগাদ রমজান আর একবার ভিতরে গেল। একি ড্রইংরুমে ডরোথি একলা বসে মদ খাচ্ছে? ওরা দুজনে গেল কোথায়? প্রথমদিন রমজান সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে জেনেছিল ডারোথির একটু বেশি নেশা হলেই জেফারসন আর ডায়না বেডরুমে চলে যেত।
জানেন সাব, ছোট লেড়কিটা বড় বেশি সরাব খেতে কিন্তু বদমাস ছিল না। বড়া লেড়কী? হা আল! এমন বদমাস লেড়কী আমি সারা জিন্দেগীতে আর দেখব না।
রাত একটা-দেড়টা দুটোর সময় ওদের দুজনকে নিয়ে রমজান গভর্নমেন্ট হাউসে ফিরত। বেঙ্গল ক্লাব থেকে রওনা হবার আগে গভর্নমেন্ট হাউস পুলিশ অফিসে ফোন করে জেনে নিত কোনো গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকবে। এক একদিন এক একটা গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকত। ডায়না গাড়ি থেকে নেমে ঠিক টুক টুক করে হেঁটে লিফট এ চড়ত কিন্তু ডরোথির দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকত প্রায়ই। কতদিন ডরোথিকে কোলে করে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে রমজান। জোয়ান বয়সে সরাব খাওয়া বেশ জোয়ান লেড়কীকে কোলে নিতে গিয়ে রমজানের রক্ত হয়তো একটু দ্রুত চলাচল করত কিন্তু তাই বলে বেইমানী? কখনও করেনি।
বাংলাদেশের চারপাশে যত বেশি বোমা-পটকা ফুটতে লাগল অ্যান্ডারসন সাহেব তত বেশি কেপে উঠলেন। কনভোকেশন অ্যাড্রেস দেবার সময় অ্যান্ডারসন সাহেবের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ বাংলা গর্জে উঠল তরুণী কিশোরীর হাতের রিভলভারের মধ্যে। আহত ব্যাঘ্রের মতো অ্যান্ডারসন সাহেবও প্রতিহিংসার নেশায় জ্বলে উঠলেন। বাংলাদেশ আর বাঙালিকে শায়েস্তা করার নেশায় চব্বিশ ঘণ্টা বিভোর হয়ে থাকতেন স্যার জন অ্যান্ডারসন।
ডায়না-ডরোথি আরো বেশি দূর সরে গেল। আরো বেশি স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ পেল।
গভর্নরের লঞ্চে গঙ্গার মোহনা দেখতে যাবার সময় মিলিটারি সেক্রেটারি স্পেশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাপ্টেন লংম্যানের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা হল ডায়নার। তারপর থেকে সময়ে অসময়ে ডায়না যাতায়াত শুরু করল লংম্যানের কোয়ার্টারে। গভর্নমেন্ট হাউসের সামনেই লংম্যানের কোয়ার্টার। কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তা কমলেও ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। ডরোথিকে নিয়ে একটু বেশি মাতামাতি শুরু করলেন।
ঠিক এই টাইমে হামার ডিউটি বদলে গেল। আমি লাটসাহাবের পার্সোন্যাল ডিউটি দিতে শুরু করলাম। লেড়কিদের ঠিক খবর রাখতে পারতাম না। তবে ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে জেফারসন সাহেবের লড়াই বেশ জমে উঠেছিল। গভর্নমেন্ট হাউসের সবাইকে জব্দ করবার জন্য জেফারসন সাহেব তো একবার ডরোথিকে নিয়ে কোথায় চলে গেলেন দো-তিন হপ্তার জন্য…
আচ্ছা?
আর কিয়া? শেষে লংম্যান সাহেবকে জব্দ করার জন্য জেফারসন সাহেব ওরই সরকারি কোয়ার্টারে রিভলভারের গুলিতে সুইসাইড করেন।
বল কি রমজান?
হ্যাঁ সাব। জেফারসন দেখাতে চেয়েছিলেন লংম্যান ওকে মার্ডার করেছে…
০৬. ডায়না-ডরোথির বেলেল্লাপনার কাহিনি
রমজানের কাছে শুধু ডায়না-ডরোথির বেলেল্লাপনার কাহিনির মধ্যে ডুবে থাকতে পারেন না ক্যাপ্টেন রায়। আমজাদের দেওয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে সকাল বেলায় লাটসাহেবের সেবা করতে গিয়ে যে-সব দর্শনার্থীর সঙ্গে পরিচয় হয়, তাতে মন ভরলেও খেয়াল চরিতার্থ করা যায় না। তার জন্য চাই ইভনিং ডিউটি বা ট্যুর। সব ট্যুর, সব ইভনিংই রঙিন হয় না কিন্তু ঘুরে ফিরে রংমশালের রঙিন আলো নজরে পড়বেই।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং এয়ারফোর্সে ফিরে গেছে অথচ পরবর্তী নেভাল এ-ডি-সি তখনও এসে পৌঁছাননি। কয়েক মাসের জন্য একজন আই-পি-এস পুলিশ অফিসার এ-ডি-সি-র কাজ করছিলেন। লাটসাহেবের ও রাজভবনের কতকগুলো আদব-কায়দা-নিয়ম-কানুন ও বৈশিষ্ট্য আছে। অনেক নিয়ম-কানুন আদব-কায়দার কথাই ফাইলে লেখা থাকে না। অনেকটা বিয়েবাড়ির স্ত্রী-আচারের মতো আর কি! বিয়ের মন্ত্র পাঁজি-পুঁথিতে পাওয়া যায় কিন্তু স্ত্রী আচার কোথাও লিখিত পাওয়া যায় না। দেখে শুনেই ওসব শিখতে হয়। লাটসাহেব ও রাজভবনের ক্ষেত্রে পাঁজি-পুঁথির মন্ত্রের চাইতে স্ত্রী আচারের প্রাধান্য ও গুরুত্বই বেশি। নতুন কোনো এ-ডি-সি-র পক্ষে এসব রপ্ত করা সহজ নয়।
টুকটাক সভা-সমিতিতে রাজ্যপালের অনুগমন করা বা ক্যাজুয়াল ভিজিটার্সদের রাজ্যপালের ড্রইংরুমে পৌঁছে দেবার কাজ নতুন এ-ডি-সি করলেও সব গুরুত্বপূর্ণ কাজই ক্যাপ্টেন রায়কে করতে হতো।
কাজের কি শেষ আছে এ-ডি-সি-র? কি না করতে হয় তাকে? লাভ-ম্যারেজের পর একলা স্বামীর ঘর করতে গিয়ে মেয়েদের যে অবস্থা হয়, এ-ডি-সিদেরও অনেকটা সেরকম। কলেজ-ইউনিভার্সিটি, কফি-হাউস-সিনেমাহল, লেক-ডায়মন্ডহারবার-দীঘার পর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের সিংহদ্বার টপকে স্বপনচারিণীকে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে হয়। চাল-ডাল-আটা-ময়দা হাঁড়ি-কড়া-হাতা-খুতীর তদারকি করতে হয়, ইন্টিরিয়র ডেকরেটর হয়ে ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল-এ চালাতে হয়, সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে স্বামীকে গান শোনাতে হয় অথবা ট্যাক্সিতে যাবার সময় স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে ন্যাকামির অভিনয় করতে হয়। আরো কত কি করতে হয়। মান-অভিমান রাগ-অনুরাগের দোলনায় দোল খেতে খেতে নার্সিংহোম ঘুরে আসার পরও স্বামীকে খুশি করার জন্য অভিসারিকা সাজতে হয়।