রমজান একটা চেয়ার নিয়ে দোরগড়ায় বসে থাকত। পাহারা দিত। বেঙ্গল ক্লাবের বেয়ারারা ট্রেতে ভর্তি করে যখন ড্রিংক নিয়ে যেত তখন রমজান একবার সেসব নেড়ে চেড়ে দেখত। একটু মেজাজের সঙ্গে জানতে চাইত, সব ঠিক হ্যায় তো?
জি হ্যাঁ।
যাইয়ে অন্দর।
প্রথম দু-এক ঘণ্টা রমজানের কানে শুধু একটু আধটু হাসির আওয়াজ ভেসে আসত। ঘড়ির কাটা আরও খানিকটা ঘোরার পরে সে হাসি আরো-প্রাণবন্ত হতে, আরো বিচিত্র হতো। শুরু হতো নাচ-গান।
.
তখনকার দিনকালই আলাদা ছিল। ইংরেজ সাহেবসুবরা দিনের বেলা ক্লাইভ স্ট্রিট ডালহৌসী চৌরঙ্গীতে বেনিয়া বৃত্তি করত। কোটি কোটি টাকা লুঠপাট করে দেশে পাচার করত। সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষ চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাপির মতো লুঠপাঠ করতেও পারে না। ওটা অসাধারণ, অস্বাভাবিক, মত্ত প্রমত্ত কাজ। তাইতো চোর ডাকাতের দল কাজের পর মদের ভাটিতে বসে, যত্রতত্র রাত্রিবাস করে।
ইংরেজ বেনিয়ারা হাজার হোক কালচার্ড। তাইতো মদের ভাটিতে বসে মাটির ভাঁড়ে বা ভাঙা গেলাসে ওদের তৃপ্তি হয় না, হতো না। ওরা ক্লাব গড়ে, বার খোলে। বেয়ারা-চাপরাশী নিয়োগ করে। শেয়াল কুকুরের মতো পশু প্রবৃত্তিতে ভরা। তবুও যত্রতত্র রাত্রিবাস? নৈব নৈব চ! ওরা ককটেল, ডিনার, ডান্সে মেয়েদের নেমন্তন্ন করে আপ্যায়ন করে, তিলে তিলে মত্ত প্রমত্ত করে। ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলে সুপ্ত প্রবৃত্তি, ইন্দ্রিয় চেতনা।
তারপর দপ করে জ্বলে উঠত আগুন।
সেকালের বেঙ্গল ক্লাব ছিল এদেরই তীর্থক্ষেত্র। জেফারসন ভাগ্যবান বলে ইন্দ্রিয় তুষ্টির জন্য পেয়েছিল অ্যান্ডারসন নন্দিনীদের। জনসন, জ্যাকসন জেন্ডারসনের অদৃষ্টে জুটত ভঙ্গ কুলীনরা।
রুম নম্বর থ্রি-ফোর ফাইভের দোরগোড়ায় রাজা হরিশ্চন্দ্রের মতো পাহারা দিতে দিতে রমজান কি না দেখত? প্রথম প্রথম সব কিছু ঠিক বুঝতে পারত না। কিন্তু কিছু দিন পর সব কিছুই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার লাগত।
বেয়ারা আবার এক বোতল হুইস্কী ও তিন-চার বোতল সোডা নিয়ে হাজির হল। রমজান ভ্রু কুঁচকে পরীক্ষা করে দেখল বোতলগুলো। হুকুম করল, যাও। পর মুহূর্তে আবার অর্ডার করল জলদি বাহার আনা!
হাজার হোক গভর্নমেন্ট হাউসের বেয়ারা! অভিজাত বেঙ্গল ক্লাবের বেয়ারারাও সমঝে চলত। জি হুজুর।
হুইস্কি সোডার খালি বোতলগুলো বেয়ারা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই দরজাটা একটু ফাঁক করে রমজান ভিতরে উঁকি দেয়। না, বেশ জমেছে। ডায়না ডরোথিকে নিয়ে স্লো স্টেপে ডান্স হচ্ছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে পাঁচজনে দুবোতল হুইস্কি ওড়ালে কুইক স্টেপে ড্যান্স করা যায়? তাহলে বেশ নেশা ধরেছে।
হাজার হোক ছোঁকরা বয়স! একটু দেখতে গিয়ে হয়তো রমজান সময়ের হিসেব রাখতে পারত না।
আবার ফিরে আসত দোরগোড়ার চেয়ারে। দেখত এপাশ-ওপাশ। দেখত কতজনের আসা-যাওয়া। হঠাৎ যেন চমকে উঠল। কে যেন আসছে এদিকে? যেন চিনি চিনি মনে হয়! রমজান তখনও ভাবছে। ভদ্রমহিলা সোজা চলে গেলেন উইলসন সাহেবের ঘরে। শাড়ি পরে উইলসন সাহেবের ঘরে?
ক্যাপ্টেন রায় প্রশ্ন করেন, বাঙালি মেয়ে?
অর কেয়া? তখন ঠিক বুঝতে পারিনি, পরে চিনেছিলাম। আগর নাম বলব তো আপনিও চিনবেন…
আমিও চিনব? অবাক হয়ে জানতে চান এ-ডি-সি।
বহুত আচ্ছি তরাসে চিনবেন। হরদম গভর্নমেন্ট হাউসে আসা-যাওয়া করছেন। মিটিং-এ লেকচার দিচ্ছেন, আখবারে ফটো ছাপা হচ্ছে…
ক্যাপ্টেন রায় আর এগুতে চান না। হাজার হোক রমজানের সঙ্গে ঠিক এসব বিষয়ে আলোচনা করা তার শোভা পায় না। মার্বেল পাথরে মোড়া রাজভবনের সর্বত্র যেন মৃত্যুর মতো শান্ত শীতল পরিবেশ। প্রাণ-চঞ্চল ক্যাপ্টেন রায় ঠিক সহ্য করতে পারেন না। অপারেশন্যাল এরিয়ায় নিঃসঙ্গতার বেদনা অনুভব করেছেন কিন্তু এমন অসহ্য মনে হয়নি। রাজপুতানার মরু প্রান্তরে ছোট তাঁবুতে থাকবার সান্ত্বনা ছিল যে সেখানে কেউ নেই, কিছু নেই। কলকাতার রাজভবনে তো কত মানুষের ভিড়, কত কি রয়েছে! অজ্ঞাত রহস্যে ভরা রাজভবনের প্রতি অসংখ্য মানুষের কত আকর্ষণ! কিন্তু ক্যাপ্টেন রায় প্রাণের স্পর্শ, ভালোবাসার উত্তাপ বিশেষ অনুভব করেন না বলেই রমজানদের একটু কাছে টেনে নেন।
তাছাড়া হাই-সোসাইটির নোংরামি রমজানের কাছে শোনার কি দরকার? সে নিজেই কি কম জানে? দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, জয়পুরে থাকার সময় কি কম দেখেছে? আমি ক্যান্টিন থেকে সস্তায় হুইস্কি পাবার জন্য কত মানুষের হ্যাংলামি দেখেছে সে! বিনা পয়সায় মদ খাবার জন্য আর্মি অফিসারদের সঙ্গে কতজন বন্ধুত্ব করে!
ওসব বাদ দাও রমজান। তুমি অ্যান্ডারসন সাহেবের মেয়েদের কথা বল।
রমজান কথার মোড় ঘুরিয়ে আবার শুরু করে ডায়না-ডরোথির কাহিনি।
রাত একটু গম্ভীর হলে জেফারসন সাহেবের বন্ধুরা একে একে বিদায় নিতেন। রমজান ওদের সেলাম জানাত। দু-পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে একবার ধীর পদক্ষেপে জেফারসন সাহেবের ঘরে ঢুকত।
ঘর?
রমজান ভিতরে ঢুকে যা দেখত তাকে হারেম বলাই ঠিক। চোখে যা দেখত, তা এ-ডি-সি সাহেবকে বলা যায় না। ডায়না জেফারসন সাহেবের কোলের ওপর লুটিয়ে থাকত আর ডরোথি আপনমনে ড্রিংক করে যেত।
রমজান অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে সেলাম করে ঘড়ি দেখিয়ে বলত, নাইট ইলেভেন। কাম গভর্নমেন্ট হাউস।