চমৎকার। এই লোকগুলোকে দেখলেও ক্যাপ্টেন রায়ের ঘেন্না করে। তাইতো আমজাদ-রমজানকে অনেক বেশি ভালো লাগে তার।
০৫. নিঃসঙ্গতার কোনো প্রশ্নই নেই
আমি লাইফে নিঃসঙ্গতার কোনো প্রশ্নই নেই। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। বিকেল বেলা মেসে ফিরেই ক্লান্ত দেহটা লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। কম বয় অনুগ্রহ করে যেদিন চা নিয়ে আসতে দেরি করত সেদিন ভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েও নিতেন। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? বিশ পঁচিশ মিনিট। না হয় আধঘণ্টাই হবে। কোনো কোনো দিন কম বয় চা নিয়ে আসতে দেরি করলেও ঘুমুতে পারতেন না পাশের ঘরের শ্রীবাস্তবের জন্য। ক্যাপ্টেন এল. পি. শ্রীবাস্তব। এলাহাবাদের হেলে না হলেও ইউ পি-র তো বটে। তাই ক্যাপ্টেন রায়ের সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা। অফিস থেকে ফিরে চিঠিপত্র পড়ার পর রোজ আসে ক্যাপ্টেন রায়ের ঘরে।
রোজ?
হ্যাঁ। মন ডে টু স্যাটার ডে। যে কদিন পোস্টাফিস খোলা থাকে আর কি। প্রত্যেক দিন বেরিণী থেকে যমুনা ত্রিবেদীর একটা চিঠি আসবেই। সে চিঠি আর কাউকে দেখাবে না। শুধু ক্যাপ্টেন রায়কে পড়াবে। না পড়িয়ে থাকতে পারে না। কেউই পারে না। ক্যাপ্টেন শ্রীবাস্তবও পারে না।
রাতের অন্ধকারে ফুল ফোটে। ভোরের আলোয় সে আত্মপ্রকাশ করে সবার কাছে। কিন্তু অমানিশার অন্ধকারেও কি সে সত্যি লুকিয়ে থাকতে পারে? অজ্ঞাত রাখতে পারে কি নিজের পরিচয়? না। চোখের আলোয় তাকে দেখা না গেলেও গন্ধ ছড়িয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় তার পূর্ণ যৌবনের খবর। শুধু ক্যাপ্টেন শ্রীবাস্তব নয়, দুনিয়ার সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে। বেরিলী-কাঠদামের পথে জীপ অ্যাসিডেন্টে বেশ আঘাত পাবার পর ডাঃ ত্রিবেণীর আস্তানায় ওকে কটি দিন কাটাতে হয় সেকথা হয়তো ওদের রেজিমেন্টের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু ওরা কেউ জানে না ওই আঘাতের যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই কাছে পেয়েছিল ডাঃ ত্রিবেদীর মেয়েকে-অধ্যাপিকা যমুনা ত্রিবেদীকে। ক্যাপ্টেন রায় ছাড়া আর কেউ জানে না ওদের কথা। অনেক কথা। অনেক কাহিনি।
যমুনা রোজ একটা চিঠি লেখে এল পি-কে। সে চিঠি নিয়ে এল পি ছুটে আসে ক্যাপ্টেন রায়ের ঘরে। বার বার পড়বে সে চিঠি। তারপর জানতে চাইবে তার অর্থ, মর্মার্থ, গুঢ় অর্থ।
রয়, হোয়াট ইজ ইওর রিঅ্যাকসান?
ক্যাপ্টেন রায় হাসতে হাসতে বলে, প্রেমে করবে তুমি আর রিঅ্যাকসান হবে আমার?
না, মানে চিঠি পড়ে তোমার কি মনে হয়? এই চিঠিটার টোল্টা একটু আলাদা না?
যমুনায় ডুব দিয়েছ তুমি আর চিঠির টোন বুঝব আমি? তাই কি হয়?
এল পি যুক্তিতর্ক বোঝে না বুঝতে চায় না। প্রেমে পড়লে যেমন অনন্য বোঝে না। ক্যাপ্টেন রায় তা উপলব্ধি করে। কিন্তু তবুও বেশ কেটে যায় বিকেল বেলার কিছু সময়।
সন্ধ্যার পর বিগ্রেড হেড কোয়ার্টাসে মেসে কিভাবে যে সময় কাটে তা কেউ খেয়াল করে। নাচ-গান, খেলাধুলো, ড্রিঙ্ক ডিনারের শেষে যখন ইশ হয়, তখন আর কতটুকুই বা রাত বাকি থাকে?
আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে এলেও আমি লাইফে কেউ নিঃসঙ্গতা অনুভব করে না, করতে পারে না।
কলকাতার রাজভবনে কয়েক শ মানুষ কাজ করেন। দিবারাত্র এক গন্ডীবদ্ধ রাজভবনে এঁরা থাকেন কিন্তু নৈকট্য নেই নিজেদের মধ্যে। প্রাণহীন ফর্মালিটি আছে, নেই ভালোবাসার উষ্ণতা, উত্তাপ, আনন্দ। স্কোয়াড্রন লিডার সিং চলে যাবার পর যখন এই নির্মম সত্য ক্যাপ্টেন রায় আবিষ্কার করলেন, তখন বড় আঘাত পেয়েছিলেন মনে মনে, আহত হয়েছিল অনেক দিনের। প্রত্যাশা, ভেঙেছিল অতীত দিনের স্বপ্ন।
আজ আর সে দুঃখ নেই। রমজানের কাছে অ্যান্ডারসেন সাহেবের মেয়েদের কীর্তি শুনতে বেশ লাগে ব্যাটিলার এ-ডি-সি সাহেবের।
আরে সাব, কি বলব আপনাকে? লেড়কি দুটো কি কাণ্ডই না করত। আমার যেমন সরম লাগত তেমনি ডর লাগত…
কেন? তোমার ভয় লাগার বা লজ্জা পাবার কি ছিল?
বুড়ো রমজান একটু না হেসে পারে না। হাসবেনা? এখন না হয় ও বুড়ো হয়েছে, অ্যান্ডারসন সাহেবের আমলে তো জোয়ান ছিল। সেই বয়সে ওই জোয়ান লেড়কিদের খিদমারী করতে সজা হবার কথা বৈকি!
বেঙ্গল ক্লাবে জেফারসন সাহেবের আতিথ্য উপভোগ করার জন্য অ্যাভারসন তনয়াদের আবির্ভাব হতে সন্ধ্যার পরই। রমজান অস্টিনের দরজা খুলে দিতেই স্বয়ং জেফারসন সাহেব অভ্যর্থনা করতেন মিস ডায়না অ্যান্ডারসন ও মিস ডরোথি অ্যান্ডারসনকে। হাজার হোক লাটসাহেবের মেয়ে! সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করতেন না ছোঁকরা জেফারসন সাহেব। টপ-হ্যাট খুলে মাথা নিচু করে বিনম্র কণ্ঠে বলতেন, গুড ইভনিং!
গুড ইভনিং!
তারপর ডান হাত এগিয়ে দিয়ে আলতো করে তুলে নিতেন ওদের ডান হাত, স্পর্শ করাতেন নিজের ওষ্ঠে। যেন রয়্যাল ফ্যামিলির কাউকে অভ্যর্থনা করা হচ্ছে।
বেঙ্গল ক্লাবের আত্মসচেতন অন্যান্য ইংরেজ বাসিন্দারা ভিড় না করলেও বেয়ারা-চাপরাশীরা ভীড় করত চারপাশে লাটসাহেবের মেয়েদের সেলাম দেবার জন্য। গর্বে অহঙ্কারে ওদের সামনে বুক ফুলিয়ে জেফারসন সাহেব ও অ্যান্ডারসন কন্যাদ্বয়কে অনুসরণ করত রমজান।
থার্ড ফ্লোর। রুম নম্বর থ্রি ফোর ফাইভ!
সাধারণত জেফারসন সাহেবের দু-একজন বন্ধুবান্ধব বোজই থাকতেন ওই সন্ধ্যাকালীন আসরে। রুম নম্বর থ্রি-ফোর ফাইভের প্রবেশ পথে তারা অভ্যর্থনা জানাতেন ডায়না ও ডরোথিকে।