তাই তো ক্যাপ্টেন রায়কে বড় সমাদর করে গ্রহণ করলেন ওঁরা দুজনে।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং খেতে বসে বললেন, প্লিজ ডোন্ট মিসটেক। পূর্ণিমা বাঙালি হলেও এ প্রোডাক্ট অফ আওয়ার রাজস্থান।
বাজে বকো না! তোমাদের দেশে ডাক্তার ছিল না বলেই তো আমার বাবাকে যেতে হয়েছিল।
এবার ক্যাপ্টেন রায়ের দিকে ফিরে পূর্ণিমা বলল, জানেন দাদা, আমার বাবাই যোধপুরের প্রথম অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার।
স্কোয়াড্রন লিডার একটু সংশোধন করে দেন, না, না, একটু ভুল হয়ে গেল। শুধু যোধপুরের নয়, সারা রাজস্থানের মধ্যে উনিই প্রথম ডাক্তার।
ওদের দুজনের মধ্যে এমনি টুকটাক ঠোকাঠুকি বেশ লাগত ক্যাপ্টেনের। বলত, আমাদের আর্মির ভাষায় তোমাদের এই বর্ডার স্কারমিশ বেশ এন্টারটেনিং!
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হাসত।
যাই হোক প্রথম কিছুকাল বেশ কেটেছে ওদের নিয়ে। সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য আর যেতো না, তবে দুপুরে-রাত্রে খেতেই হতো।
ক্যাপ্টেন রায় বলেছিল, সিং, দিস কান্ট বি দি রেগুলার ফিচার। তোমাকে এর বিনিময়ে…
স্কোয়াড্রন লিডার জিভ কেটে বলেছিল, মাই গড! আমি মাড়বারের লোক হতে পারি কিন্তু ঠিক এতটা ব্যবসাদার নই। তাছাড়া ডক্টর মুখার্জীর মেয়ে ঠিক দুজনের সংসার চালাতে শেখেনি।
ওরা যতদিন ছিল রমজান বা আমজাদের সঙ্গে ঠিক মিশতে পারেননি ক্যাপ্টেন। প্রয়োজন হয়নি। তাগিদ বোধ করেননি ওদের কাছে টেনে নেবার। রমজানের কাছে অ্যান্ডারসন সাহেবের ছোঁকরীর কাহিনি শোনার চাইতে পূর্ণিমার সঙ্গে খোসগল্প করার টান ছিল অনেক বেশি।
আচ্ছা দাদা, একদিন ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে যাবেন?
তুমি ডায়মন্ডহারবার যাওনি?
চোখ দুটো ঈষৎ ঘুরিয়ে সিং-কে একটু আড় চোখে দেখে পূর্ণিমা বলে, ওই মরুভূমির লোকটার কোনো রসবোধ আছে?
স্কোয়াড্রন লিডার সঙ্গে সঙ্গে টিপ্পনী কাটে, ইউ আর পারফেক্টলি জাস্টিফায়েড পূর্ণিমা। আমার রসজ্ঞান নেই বলেই আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয় গান শুনে তোমার কাছে সারেন্ডার করেছিলাম।
ক্যাপ্টেন রায় হাসতে হাসতে বলেন, সিং এয়ার ফোর্সে অফিসার হয়ে এসব সিক্রেট ডিসক্লোজ করা অন্যায়।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং হঠাৎ বদলি হয়ে চলে গেল আম্বালা। এতদিন পরে ক্যাপ্টেন রায় আবিষ্কার করলেন, এই পাথরে গাঁথা রাজভবনে মনের আনন্দ, প্রাণের রসের বড় অভাব। অনুভব করলেন তিনি বড় নিঃসঙ্গ।
চুপচাপ নিজের ঘরের মধ্যে শুয়েছিলেন তিনি। দরজাটায় নক করে আমজাদ এল ভিতরে। একমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, ক্যাপ্টেন সাব, মন খারাপ করবেন না। যান একটু ঘুরে আসুন।
মুখে কিছু বললেন না ক্যাপ্টেন রায়। তবে সেই প্রথম উপলব্ধি করলেন, যাদের এতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, যাদের দেখেও দেখেননি, যাদের মানুষ বলে স্বীকার করতে চাননি, তাদেরও প্রাণ আছে, আছে হৃদয়, আছে সহানুভূতি।
ডিউটির পর এখন আর চুপচাপ বসে থাকতে চান না ক্যাপ্টেন। ডেকে নেন রমজান, আমজাদ আলিকে। গল্প বলেন, গল্প শোনেন। শোনেন অ্যান্ডারসন সাহেবের মেয়েদের কীর্তি। স্কোয়াড্রন লিডার সিং চলে যাবার পর আর কোনো অফিসারের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রায় বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে তুলতে চাননি। আশা করেছিলেন সেক্রেটারি বা ডেপুটি সেক্রেটারির সংসারে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা পাবেন। ওদের সংসারের পাঁচ জনের একজন হয়ে কাটিয়ে দেবেন। কলকাতায় কটা বছর। বাংলাদেশের বাঙালি তো মিশুক হয় বলেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছেন। কলকাতায় আত্মীয়স্বজন না থাকলেও বন্ধুহীন হয়ে নিশ্চয়ই কাটাতে হবে না।
এসব কথা মনে হলে ক্যাপ্টেন রায়ের হাসি পায়। তাইতো আমজাদ-রমজানের দল এগিয়ে। আসতে তাদের ফিরিয়ে দেননি, নিজেও এগিয়ে গেছেন ওদের কাছে। ভালোই হয়েছে। রমজান-আমজাদের কাছে কত কি জানতে পেরেছেন, শিখতে পেরেছেন! এই রাজভবনে তো কোনো অফিসার নেই, যিনি অ্যান্ডারসন সাহেবের কাহিনি বলতে পারেন। কে জানে ওর মেয়েদের বেলেল্লাপনার কাহিনি?
দু-একজন বুড়ো কেরানি হয়তো জানে কিন্তু তারা কিছুতেই ইংরেজ লাটের নিন্দা করবে। ইংরেজদের কাছে অহর্নিশি অপমান সহ্য করে চাকরি করতে হয়েছে এদের। তবু এরা। আজ ইংরেজ বলতে বিভোর হয়।
আমজাদ বেশি কথা বলে না। তবুও সেই আমজাদের মুখেই ক্যাপ্টেন রায় শুনেছিলেন, আজকাল লম্বা-চওড়া কথা বলেন কিন্তু আমরা তো সরকার বাবুকে ইংরেজ আমলেও দেখেছি।
কেন ইংরেজ আমলে উনি কি করতেন?
শুনলে বিশ্বাস করবেন?
কেন করব না?
তবে শুনে রাখুন এইসব বাবুদের কীর্তি।…
সারা বাংলাদেশের পি-ডবলিউ-ডি ডিপার্টমেন্টের যত ওভারশিয়ার ছিল, তাদের মধ্যে সব চাইতে ইংরেজভক্ত খুঁজে বার করতে চীফ ইঞ্জিনিয়ার মাস ছয়েক সময় নিলেন। সেকালে বাঙালি ছোঁকরাদের সরকার বাহাদুর বিশ্বাস করতেন না বলেই এই সামান্য কাজের ভার স্বয়ং চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে দেওয়া হয়েছিল। চীফ ইঞ্জিনিয়ার নিজেই সিলেক্ট করতে পারতেন তবে কে কোথা থেকে কি করে বসে–এই ভয়ে দুজনের নাম সুপারিশ করে পাঠিয়েছিলেন ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারির কাছে।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত রাজভক্তির সিংহদ্বার পার হলেন শ্রীনিশিকান্ত সরকার। আমাদের সরকার মশাই।