আমজাদ আলি, রমজানের দল এজন্য কিছু মনে করত না। ওইটাই তো নিয়ম।
ব্যাচিলার এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায়কে রাজভবনের সামনের ওই স্যান্ডস্টোনের স্পর্শ-ধন্য কোয়ার্টারে আশ্রয় নিতে হয়নি। ওই গুটিকতক কোয়ার্টার নিয়ে মারামারি যেসব সরকারি অফিসারের দল সরকারি পয়সায় বার কয়েক দার্জিলিং ঘুরে পাহাড়ের প্রেমে হাবুডুবু খান, ওই কোয়ার্টারগুলির প্রতি তাদের বড় মোহ, বড় আকর্ষণ। লাটসাহেবের ঘোড়ার আস্তাবল ও মোটরের গ্যারেজের পাশে বা উপরে থাকার ইজ্জত কি বাগবাজার বা ভবানীপুরে সম্ভব? লাটসাহেবের সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি ছাড়াও আরও দুজন একজন অফিসের আস্তাবল-গ্যারেজের পাশে অফিসার্স কোয়ার্টাসে আস্তানা পান। ভাগ্যক্রমে ম্যারেড এ-ডি-সি-ও পেতে পারেন ওর একটি সুইট।
অফিসারের দল সাজিয়ে গুছিয়ে নিজের নিজের ফ্ল্যাটকে মিনিয়েচার রাজভবন করে রাখেন। ছমাস-এক বছর কাশ্মীরি কার্পেট প্রিন্স অফ ওয়েলস বা ডাফরিন সুইটে রাখার পর সেগুলো চলে যায় ওই আস্তাবলের পাশের অফিসারদের ফ্ল্যাটে। আরো অনেক কিছু চলে যায় ওইসব অফিসার্স ফ্ল্যাটে। থ্রোন রুমের চেয়ার, কাউন্সিল চেম্বারের পর্দা, লাটসাহেবের ড্রইংরুমের সোফা থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু নজরে পড়বে ওইসব মিনিয়েচার রাজভবনগুলিতে।
বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? রমজান বা আমজাদ আলিকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। ওরা তো সিনিয়র কর্মচারী। নতুন ছোঁকরা বেয়ারা-চাপরাশীদের জিজ্ঞাসা করুন। ওরাই সব বলে দেবে। বলে দেবে যে কিছু কিছু অফিসারের বিছানার গদি, চাঁদর, বেডকভার, বাথরুমের তোয়ালে, গায়ে মাখা সাবান পর্যন্ত আসে ওই বড় রাজভবনের স্টোর থেকে।
রাজভবনের অধিকাংশ অফিসারই এইসব উপরি পাওনা নিয়েই মত্ত। রমজান বা আমজাদের সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করার মেজাজ বা প্রবৃত্তি কোথায়?
ক্যান্টেন রায় খাস রাজভবনের অন্দরমহলে আস্তানা পেয়েছিলেন স্বয়ং হিজ একসেলেন্সির অর্ডারে। তাই রমজান বা আমজাদকে বেশি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি।
প্রথম প্রথম ডিউটির পর চলে যেতেন অফিসারদের কোয়ার্টারে প্লেট ভর্তি কাজু আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় কফি খেতে খেতে আড্ডা দিতে বেশ লাগত। সকালে, দুপুরে কাজ না থাকলে চলে যেতেন এ-ডি-সি স্কোয়াড্রন লিডার নরেন্দ্রপ্রসাদ সিং-এর কোয়ার্টারে। বিকানীরের মরুভূমির লোক হলেও মনটা বড় সরল, সহৃদয়।
ক্যাপ্টেন রায়ের আজও মনে পড়ে সেদিনের কথা। এ-ডি-সি ইন ওয়েটিং ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সিং। তিনিই ক্যাপ্টেনকে নিয়ে গিয়েছিলেন গভর্নরের কাছে। তারপর পরিচয় করিয়েছিলেন অন্যান্য অফিসার ও কর্মীদের সঙ্গে। অতগুলো লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে করতেই অনেক বেলা হয়ে গেল।
রাজভবনের দক্ষিণের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে স্কোয়াড্রন লিডার সিং একবার ঘড়িটা দেখে বললেন, কাম অন, লেট আস রাস ফর লাঞ্চ।
ক্যাপ্টেন রায় জানতে চইলেন, কোথায় খেতে যাবেন?
কোথায় আবার? আমার কোয়ার্টারে।
আবার আমার জন্য…
সিং মুখে কিছু জবাব দেয়নি, শুধু একটু হেসেছিল। প্রায় ডবল মার্চ করার মতো লম্বা পা ফেলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির হল কোয়ার্টারে।
পর্দা সরিয়ে সামনে ড্রইংরুমে ঢুকতেই যিনি অভ্যর্থনা করলেন, তিনি মিসেস পূর্ণিমা সিং।
ক্যাপ্টেন মীট মাই ওয়াইফ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা সিং হাত জোড় করে একটা নমস্কারও করলেন না। আর মীট মাই ওয়াইফ করতে হবে না, চল খেতে চল।
ক্যাপ্টেন রায় অতি পরিষ্কার স্পষ্ট বাংলা কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এক ঝলক দুজনের দিকে তাকিয়ে মিসেস সিং-এর উদ্দেশ্যে বললেন, চমৎকার বাংলা শিখেছেন তো!
পূর্ণিমা মুচকি হেসে পর্দা সরিয়ে ভিতরে চলে গেল!
স্কোয়াড্রন লিডার সিং একটু চাপা গলায় বললেন, ক্যাপ্টেন বিয়ের আগে সী ওয়াজ মিস পূর্ণিমা মুখার্জী।
আই সি!
পূর্ণিমা বাঙালি হলেও মোধপুরের মেয়ে। জন্ম, মামাবাড়ি পাটনাতে হলেও মোধপুরে কাটিয়েছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন। পূর্ণিমার বাবা যোধপুরের সর্বজনপ্রিয় বাঙালি ডাক্তার! সারাদিন ডাক্তারি করে সন্ধ্যার পর তাস-পাশা-চা-সিগারেট। রবিবারে তানপুরা, হারমোনিয়াম তবলা। নিজে গাইতেন আয়েনা বালম, স্ত্রী গাইতেন একটি নমস্কারে প্রভু, মেয়ে পূর্ণিমা গাইত তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
সন্ধ্যাবেলার সে আড্ডায় কে না থাকতেন? হিজ হাইনেসের প্রাইভেট সেক্রেটারি, ডেপুটি কমিশনারের স্ত্রী, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে যোধপুর এয়ারফোর্স স্টেশনের ছোট বড় অফিসারের দল। আসতেন ফ্লাইট লেফটন্যান্ট নরেন্দ্রপ্রসাদ সিং।
সে এক ইতিহাস! কলকাতার রাজভবনের অফিসার্স ফ্ল্যাটে এসেও পূর্ণিমা ভুলতে পারে না পুরনো দিনের সন্ধ্যাবেলার মজলিশ। কলকাতায় ঠিক আত্মীয়-বন্ধু কেউ নেই। আর রাজভবনের অফিসাররা সন্ধ্যাবেলায় তানপুরা হাতে নিয়ে বসবার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
স্কোয়াড্রন লিডার সিং যখন বাংলাদেশের গভর্নরের এ-ডি-সি মনোনীত হলেন, তখন আনন্দে, খুশিতে ফেটে পড়েছিল পূর্ণিমা। এ তোমাদের বিকানীর বা চণ্ডীগড় নয়। দেখো কি মজা করেই দিন কাটবে।
এখন সন্ধ্যা যেন কাটতে চায় না। কত সিনেমা-থিয়েটার দেখা যায়? তাছাড়া পূর্ণিমা তো বাইরের আনন্দের চাইতে ঘরের আনন্দই বেশি চায়। সিং-এর যেদিন ইভনিং ডিউটি থাকে, সেদিন পূর্ণিমা সীতার বনবাসের শুন্যতা অনুভব করে মনে মনে।