- বইয়ের নামঃ এ-ডি-সি
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বিরাট আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে
বিরাট আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্যাক ব্রাশ করতে করতে ক্যাপ্টেন রায় গুনগুন করে সুর আওড়াচ্ছিলেন, এ মণিহার আমায় নাহি সাজে–।
কোন্ মণিহার? আমি অফিসার হয়ে এই এ-ডি-সি-র চাকরি? নাকি মণিকা?
বোধহয় মনে মনেই নিজেকে প্রশ্ন করেন ক্যাপ্টেন রায়। মুখে কিছু বলেন না, শুধু ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সামনের আয়নায় দেখে চোখ দুটো কেমন যে রোমান্টিক হয়ে নীরব ভাষায় কত কথা বলে।
ব্যাক ব্রাশ করতে করতেই একবার হাতের ঘড়ি দেখে নেন। না, ঠিক আছে। এখনও পঁচিশ মিষ্টি হাতে আছে।
মুখোনা একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে নেন। ঠিক আছে তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ দেখাচ্ছে। সকাল বেলায় হট বাথ নেবার পর শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও বেশ সতেজ হয়ে ওঠে। তারপর ইউনিফর্ম পরলে বেশ লাগে।
ব্রাশটা নামিয়ে রাখলেন। এবার একটু পিছিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবার ভালোভাবে দেখে নেন। ও-কে!
আবার গুগুন করে কি যেন একটা সুর আওড়াতে আওড়াতে ক্যাপ্টেন রায় ওপাশে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা সেন্টার টেবিল থেকে আর্ম ব্যাচটা তুলে নিলেন। স্যাফরন কলারের ব্যাচের মাঝে ভুলে যাওয়া অতীত ভারতের অশোকস্তম্ভ। ওটা এখন ভারতের প্রতীক। আর্ম ব্যাচের ওই অশোক পিলারের প্রতিকৃতি দেখে মুচকি হাসেন ক্যাপ্টেন রায়। হাসবেন না? মনে মনে ভাবেন যদি কোনো মাস্টারমশাই ধরনের লোক জিজ্ঞাসা করেন, ওহে ছোঁকরা, বৈষ্ণবদের। তিলক কাটার মতো সর্বাঙ্গে তো অশোকস্তম্ভের ছড়াছড়ি! বলতে পার সম্রাট অশোক কোথায় জন্মেছিলেন? কবে জন্মেছিলেন? এই অশোকস্তম্ভ কোথায় পাওয়া গিয়েছিল?
এসব কিছু জানে না সে। হয়তো স্বয়ং গভর্নরই…। চাকরি করতে কি জ্ঞান বুদ্ধির দরকার হয়? তাহলে তো প্রায় কারুরই চাকরি বাকরি করা হতো না। ইউনিভার্সিটির একটা চোথা সার্টিফিকেট হলেই সরকারি চাকরি পাওয়া যায়। বিদ্বান, বুদ্ধিমান বা কর্তব্যপরায়ণ হলে চাকরিতে বিভ্রাট হয়।
এই সাত সকালে যত সব আজেবাজে চিন্তা! ক্যাপ্টেন রায় আর্ম ব্যাচটি তুলে হাতে পরেন। বেশ লাগে দেখতে।
চট করে আবার হাতের ঘড়ি দেখে নেন। না, না, আর দেরি নয়। আটটা কুড়ি হয়ে গেছে। মাত্র দশ মিনিট বাকি। ওপাশের টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে পার্সটা পকেটে পুরে নিলেন, পেন, বলপেনটাও তুলে নিলেন।
দরজায় দুবার নক করার আওয়াজ হল।
কাম ইন।
অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেটের একটা টিন ও একটা দেশলাই হাতে করে আমজাদ আলি ঘরে ঢুকল।
নমস্তে। নমস্তে বলেই হাত বাড়িয়ে সিগারেটের টিন আর দেশলাইটা নিলেন ক্যাপ্টেন রায়।
সব সময় অবশ্য গৌরবে বহুবচন হয় না। গভর্নরের অবর্তমানে বা প্রোটোকলের নিয়মানুসারে অনেক সময় এ-ডি-সি-কেই গভর্নরের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। ভাগ্যক্রমে অনেক সময় সে-সব ছবিও খবরের কাগজের পাতায় পরদিন সকালে দেখতে পাওয়া যায়।
আমজাদ আলি বেড-টি তৈরি করতে করতেই ক্যাপ্টেন রায় দেখে নেন খবরের কাগজের পাতায় নিজের বা অন্য সহকর্মীর ছবি। বেশ লাগে। চীফ অফ দি আমি স্টাফের ছবি নানা কারণে খবরের কাগজে ছাপা হলেও লেফটেনান্ট জেনারেল বা মেজর জেনারেলের ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয় না বললেই চলে। অথচ ক্যাপ্টেন রায়ের মতো এ-ডি-সি-দের ছবি হরদম কাগজে ছাপা হচ্ছে।
একটা স্কুল গ্লোবের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে যে সময় লাগে, তার চাইতেও কম সময়ে বিশ্ব সংবাদ পরিক্রমা সমাপ্ত করেন এ-ডি-সি সাহেব। তারপর দেখে নেন গভর্নরের কোনো ছবি আছে কিনা। সত্যিকার কোনো ভি-আই-পি-র আগমন নির্গমন হলেই গভর্নর সাহেবকে যেতে হয় দমদম এয়ারপোর্টে। এক গোছ ফুল তুলে দিতে হয় সেই ভি-আই-পি-র হাতে। অথবা দন্ত বিকশিত করে একটা হ্যাঁন্ডসেক। ব্যাস! সূর্যের আলোকে ম্লান করে দিয়ে জ্বলে উঠবে প্রেস ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ বাম্বের আলো। হাই অফিসিয়াল আর পুলিশের হুড়োহুড়িতে তখন কেউ খেয়াল করেন না, কিন্তু পরের দিন সকালের কাগজগুলিতে ঠিক দেখা যাবে কি একটা অজ্ঞাত কর্তব্য সম্পাদনের জন্য ভি-আই-পি আর গভর্নরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সোনালি-রূপালী বিচিত্র পোশাক পরা এ-ডি-সি!
সভা-সমিতি, লাঞ্চ-ডিনারে গভর্নর বক্তৃতা দিলেও অনেক সময় ছবি ছাপা হয়। সেখানেও লাটসাহেবের পাশে পাওয়া যাবে এ-ডি-সি-কে।
আমজাদ বেড-টি দিয়ে চলে যায়। আবার আসে ঠিক সাড়ে সাতটায়। প্রায় আড়াই ফুট লম্বা রূপোর ট্রে করে নিয়ে আসে ব্রেকফাস্ট। আর আসে এই আটটা পঁচিশে। সিগারেট-দেশলাই দিতে।
অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেটের টিনটা পকেটে পুরতে পুরতে আবার হেসে ফেলেন ক্যাপ্টেন রায়। হাসবেন না? অশোকস্তম্ভ মার্কা এই সিগারেট খাদি প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় না। পাক্কা বিলেতি কোম্পানির সিগারেট ডবল মাশুল দিয়ে এই স্বদেশীপনার ন্যাকামি প্রচার করা হয় দেশ-বিদেশের অতিথিদের কাছে। দুষ্টু সন্ন্যাসীরা যেমন কাঁচা বিধবা সেবাইত রেখে ভোগ করেন, অনেকটা সেই রকম আর কি! সাধাসিধে মানুষদের ধোঁকা দেবার জন্য চাই মোটা খদ্দর আর রাতের আবছা আলোয় চাই পাক্কা স্কচ! ইতালিয়ান ভারমুখ বা মার্টিনী হলেও চলবে না।