আমি প্রশ্ন করলাম, কেন বলুন তো?
কেন আবার? প্রেম করলে বিয়ে হবে না, বিয়ে করলে প্রেম হবে না বলে।
আমি কোন কথা বললাম না, শুধু একটু মুচকি হেসে জানালা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকালাম।
মিঃ দত্ত বললেন, হাসালেন স্যার! এটা আমার কথা নয়; ফ্রাঙ্কলিন বলে গেছেন–Where theres marriage without love, there will be love without marriage.
মিঃ দত্তের কথায়-বার্তায় আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। ইংলিশ চ্যানেল পার হবার আগেই আমাদের পরিচয় গভীর হয়েছিল ওর হৃদয়-মাধুর্যে। লণ্ডনে গিয়ে আলাদা হোটেলে থাকবার অনুমতি দিলেন না আমাকে। প্রথমে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম কিন্তু মিঃ দত্ত কোন ওজর আপত্তি শুনলেন না। বললেন, স্যার জানেনই তো লাইফ ইজ বাট এ্যান ওয়ার্কিং স্যাডো। সুতরাং যে কদিন আছি একটু আনন্দ করতে দিন না! বাধা দিচ্ছেন কেন?
মিঃ দত্তের আতিথ্যে অল্ডউইচের ধারে হোটেল ওয়ালডর্ফেই উঠলাম। দুটি সপ্তাহ শুধু একসঙ্গেই ছিলাম না, তমাল দত্তের মনের গ্রন্থির সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। পার্বত্য নদীর মত উচ্ছল আনন্দময় যে তমাল দত্তকে দুনিয়ার সবাই জানেন, চেনেন, ভালবাসেন, সে তমাল দত্তকে আমি ঠিক দেখতে পাইনি। তমাল দত্তের চোখে জল দেখিনি কিন্তু মনের কান্না শুনতে পেয়েছিলাম। হাসি-খুশী ভরা তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে হয়তো অনেকে ডুব দেবার প্রয়োজন বা তাগিদ বোধ করেননি। কিন্তু তমাল দত্তের অতি উচ্ছলতা দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিরাট ক্ষত আছে; আর সেই ক্ষতটাকে ঢেকে রাখবার জন্যই তার সমস্ত উচ্ছলতা।
দুচার দিন ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার পরই আমি বেশ বুঝতে পারলাম কোন্ সুদূর অতীতে উনি কোথায় যেন একটা হোঁচট খেয়েছিলেন এবং সেদিনের সে-দুঃখ সে-আঘাতকে ভোলবার জন্য আজ গেলাস-গেলাস হুইস্কী খান, অসংখ্য মানুষের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হো হো করে হেসে ওঠেন।
সুযোগ আসতে খুব বেশী দেরী হলো না। আমি জানতাম উইক এণ্ডে মিঃ দত্তের অনেকগুলো ইনভিটেশন ছিল কিন্তু তবুও শুক্রবার রাত্তিরে হোটেলে ফিরে ওকে এক বোতল হোয়াইট হর্স নিয়ে বসে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না। ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে করতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার দত্তসাহেব? শুক্রবারের বারবেলায় সখীদের কাঁদিয়ে একলা-একলা একি করছেন!
জানেন স্যার, পেশাদার অভিনেতারাও অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একটা সময় আসে যখন তারাও অভিনয় ছেড়ে ঘর-সংসারী হন। কিন্তু আমার জীবনে সে সুযোগটাও তো আসবে না, তাইত মাঝে-মাঝে একটু একলা থাকি।
সামনের বোতলটা হাতে নিয়ে বললেন, একলা একলা এই হোয়াহট হর্সে চেপে ঘুরে বেড়াই। আর কি করব বলুন?
কথাটার ঠিক মর্ম বুঝলাম না। মিঃ দত্তের মুখোমুখি হয়ে সেন্টার টেবিলের ওপাশে বসে বললাম, কেমন যেন রোমান্টিক হয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
গেলাসে আরো খানিকটা হুইস্কী ঢালতে-ঢালতে জিজ্ঞাসা করলেন, গগন হরকরার নাম শুনেছেন?
লণ্ডনের ওয়ালডর্ফ হোটেলের রুম নম্বর থি-ফাইভ-ফোরে বসে হঠাৎ গগন হরকরাকে মনে করা সহজ হয়নি। মিঃ দত্ত খালি গেলাসে একটু হুইস্কী ঢেলে বললেন, একটু তাজা হয়ে নিন। সত্যি একচুমুক হুইস্কী-সোডা খেয়ে মনে পড়ল গগন হরকরার কথা। বললাম, আপনি সেই গগন হরকরার কথা বলছেন যে লিখেছে আমি কোথায় পাব তারে?
ঠিক ধরেছেন স্যার।
একটু থেমে এক ঢোক হুইস্কী খেলেন, একটা টান দিলেন হাতের সিগারেটে।…জানেন স্যার আজ রোমান্টিক বলে ঠাট্টা করতে পারেন কিন্তু একদিন সত্যিই আমি রোমান্টিক ছিলাম। আজও সেই রোমান্সের আগুনে তিলে তিলে পুড়ে মরছি। গগন হরকরার ভাষায় কি বলতে ইচ্ছে করে জানেন?
কি?
বলতে ইচ্ছে করে—
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই কেমন
করে। মরি হায় হায় রে।
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
সেই উইক-এণ্ডের শুক্রবার রাত্তিরে তমাল দত্তের অতীত জীবনের এক অজ্ঞাত অধ্যায়ের ইতিহাস মিঃ দত্ত নিজেই আমাকে শুনিয়ে ছিলেন।
…আমাদের বালী গ্রামের গোঁসাইপাড়ায় হারাধন বাঁড়ুজ্যের বাড়ীতেই এক কালে আমার সারাদিন কেটেছে। স্কুল-কলেজ পালিয়েও বাঁড়ুজ্যে বাড়ীর আড্ডাখানায় বা বাঁড়ুজ্যে মাসিমার রান্না ঘরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়েছি। গঙ্গায় নতুন ইলিশ উঠলে মাকে বলতাম না, বলতাম বাঁড়ুজ্যে মাসিমাকে–মাসিমা, কাল নতুন ইলিশ দিয়ে ভাত খাব। মাসিমা বলতেন, খাবি কিরে? আজই তোর জন্যে ইলিশ আনিয়েছি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার দুমাস আগে টাইফয়েড হলে মা ছাড়া আর যাঁরা রাত জেগেছেন, মানত করেছেন সে হচ্ছে বাঁড়ুজ্যে মাসিমা আর সুলতা। মা তো মাঝে-মাঝেই অভিমান করে মাসিমাকে বলতেন, ছেলেটাকে আমি পেটে ধরেছি কিন্তু ছেলেটা তোরই।
যাই হোক, বয়স একটু বাড়লে হঠাৎ খেয়াল হলো সুলতাকে ভালবেসেছি। একদিন মেসোমশাই দোকানে যাবার পর মাসিমা চলে গেলেন কল্যাণেশ্বরতলায় পূজা দিতে। সুলতাকে ডেকে বললাম, লতা শুনে যা। সুলতা কাছে এসে বললাম, তোর হাতটা দেতো। লতা হাত বাড়িয়ে দিলে নিজের হাতের মধ্যে ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, লতা, একটা কথা বলব?