আমাদের পাড়ার সরলা পিসিমা বলেন, ও হতচ্ছাড়াকে তো শিবরাত্তিরের দিন পশুপতিনাথে, প্রয়াগের কুম্ভমেলায় আর যে-কোন মানুষ মরলে শ্মশানঘাটেও পাওয়া যায়।
এক কথায় বাঙালীর একটি পরম গর্বের বস্তু হচ্ছে তমাল দত্ত। বাংলা দেশের দ্বারদেশে তমাল দত্তকে শশা-রুমে সাজিয়ে রাখলেও নিশ্চয়ই কেউ আপত্তি করবেন না।
আমার পোড়া কপাল বাংলাদেশে জন্মে, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েও একটি বারের জন্য প্রভুর দর্শন পাইনি। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে দু-একবার কানের পাশ দিয়ে বন্দুকের গুলি চলে যাবার মতো একটুকুর জন্য তমাল দত্তের সঙ্গে দেখা হয়নি। এইত সেবার বার্লিনে গিয়ে পৌঁছলাম বিকেলের দিকে। সন্ধ্যায় কেম্পিনিস্কি হোটেলের বারে বসে দু-চারজন পরিচিত-অপরিচিতের সঙ্গে আড্ডা দেবার সময় শুনলাম, লাঞ্চের পর প্যান এ্যামেরিকান ফ্লাইটে ফ্রাঙ্কফার্ট হয়ে নিউইয়র্ক চলে গেছেন। মিসফরচুন নেভার কামস অ্যালোন। লণ্ডনেও ঠিক এমনি এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার। হতাশায় বেদনায় বহুসময় দীর্ঘনিশ্বাস পড়ত এবং প্রায় অন্যমনস্কভাবে হাই তুলে তুড়ি দিতে দিতে বলতাম, সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।
একদিন ছিল যখন আমি এমনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতাম। আজ আর আমার সে-দুঃখ নেই। উপরওয়ালা আমার মনের কান্না নিশ্চয়ই শুনেছিলেন তা নয়তো অমনভাবে তমাল দত্তের সঙ্গে জেনেভা এয়ার পোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে দেখা হয়!
……এক বন্ধু দর্শনের জন্য মস্কো থেকে সোজাসুজি লণ্ডন না গিয়ে জেনেভা হয়ে যাবার ঠিক করেছিলাম। হাতে ঘণ্টা পাঁচেক সময় ছিল। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আধঘণ্টা–পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেই আবার এয়ারপোর্টে ফিরে এলাম। ব্রিটিশ ইউরোপীয়ান এয়ারওয়েজের কাউন্টারে টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে যখন ট্রানজিট লাউঞ্জে ঢুকলাম তখনও বেশ সময় আছে। এতোটা আগে না এলেই হতো কিন্তু ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে নানা দেশের বিভিন্নমুখী যাত্রীদের আমার বেশ লাগে বলেই হাতে একটু সময় নিয়ে এসেছিলাম। পাঁচ-দশ মিনিট স্যুভেনির সপে দাঁড়িয়ে সুইস হস্তশিল্পের নিদর্শন দেখার পর এক কোণায় এক কাপ কফি নিয়ে বসে বসে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিচ্ছিলাম চারদিকে। দুএকজন ভারতীয় নারী-পুরুষকেও দেখেছিলাম কিন্তু সেখানে দৃষ্টিটাকে আটকে রাখার আকর্ষণ বা প্রয়োজন বোধ করিনি। কফির পেয়ালা শেষ করে একটা সিগারেটের আধাআধি শেষ করতে না করতেই কানে ভেসে এলো…প্যাসেঞ্জার্স ট্রাভেলিং টু লণ্ডন বাই বি-ই-এ ফ্লাইট ফোর জিরো ওয়ান আর রিকোয়েস্টেড টু প্ৰসিড টু গেট নাম্বার সিক্স। পৃথিবীর নানান দেশের একদল যাত্রী ছনম্বর গেটের কাছে জমায়েত হলেন। গ্রাউণ্ড হোস্টেস প্রতিটি যাত্রীর কাছ থেকে বোর্ডিং কার্ড ফেরৎ নিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্টে একটা চিহ্ন দিয়ে দিলেন। গেটের বাইরে বাসের সামনে যখন অপেক্ষা করছিলাম, গ্রাউণ্ড হোস্টেস আমাদের অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মিনিট খানেক বাদেই মাইক্রোফোনে শুনতে পেলাম… লণ্ডন-বাউণ্ড প্যাসেঞ্জার মিঃ টামাল ডাটটা! আপনি তাড়াতাড়ি ছনম্বর গেটে আসুন। তিনবার এই একই ঘোষণা মাইক্রোফোনে প্রচার করা হয়েছিল কিন্তু তমাল দত্ত আমার সঙ্গে একই প্লেনে লণ্ডন যাবেন শুনে উত্তেজনায় আমি প্রথমবারের ঘোষণা ছাড়া, পরের দুটি ঘোষণা শুনতে পাইনি। আগ্রহে উত্তেজনায় আমি ট্রানজিট লাউঞ্জের দিকে চেয়ে রইলাম। দুএক মিনিট পরই একজন সুদর্শনা পশ্চিমী এসে যে কৃষ্ণকায় ভদ্রলোকটিকে ছনম্বর গেটের সামনে বিদায় জানিয়ে গেলেন তিনিই যে আমাদের পরম গৌরব তমাল দত্ত, সে বিষয়ে আমার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। প্লেনে চড়বার সময় অনেক সহযাত্রীর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে আমি শেষ পর্যন্ত মিঃ দত্তর পাশে আসন নিলাম। ভেবেছিলাম আমিই আগে আলাপ করব কিন্তু তা আর হলো না। হাতের ব্রীফ কেসটা সীটের নিচে রেখে কোমরে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে মিঃ দত্ত বললেন, মনে হচ্ছে আপনি ইণ্ডিয়ান..।
শুধু ইণ্ডিয়ান নই, বাঙালীও।
মিঃ দত্ত বললেন, জানেন মশাই গড ইজ ভেরী কাইণ্ড টু মী। যখন যেখানে যেটি চেয়েছি একবার ছাড়া ভগবান আমাকে কোনদিন ব্যর্থ করেননি। কদিন জেনেভায় বেশ হৈ চৈ করে কাটাবার পর কেমন করে একলা-একলা চুপচাপ একটা ঘণ্টা প্লেনে কাটাব তাই ভাবছিলাম। উপরওয়ালা ঠিক জুটিয়ে দিলেন আপনাকে।
মনে-মনে আমিও উপরওয়ালাকে স্মরণ করছিলাম, তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম এমন একটি পরম-পুরুষ মহাপুরুষের সঙ্গে আমার পরিচিত হবার আশ্চর্য সুযোগ দেবার জন্য।
প্লেন কিছুক্ষণের মধ্যে তীরবেগে উপরে উঠে গেল। কোমর থেকে বেল্ট খুলে দুজনে সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে প্রথম সুখটান মেনে মিঃ দত্ত প্রশ্ন করলেন, বিয়ে করেছেন স্যার?
না।
করবেন নাকি?
করব না বলে তো ভাবিনি এখনও।
এই মেরেছে। আপনার মতলব তো সুবিধে মনে হচ্ছে না। আমার কানের কাছে মুখটা এনে মিঃ দত্ত ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রেমে পড়েছেন নাকি?
আমি একটু হেসে উত্তর দিলাম, ইচ্ছা তো করে কিন্তু পেলাম কোথায়?
এয়ার হোস্টেস কফি দিয়ে গেল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিঃ দত্ত বললেন, মেয়েদের ব্যাপারে আমার চাইতে অভিজ্ঞ লোক বাংলাদেশে অন্তত নেই। তাই বলছিলাম স্যার, ওসব ঝামেলায় আর জড়াবেন না!