অনেক ঔষধ-পত্র ডাক্তার-নার্স করবার পরও বৌদি ষোল ঘন্টা অজ্ঞান ছিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, জ্ঞান হবার পর একফোঁটা চোখের জল ফেলেননি বৌদি। শোকে-দুঃখে বৌদি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। তিন দিন তিন রাত্রি একবিন্দু জল পর্যন্ত স্পর্শ করলেন না। সপ্তাহ খানেক পর বৌদি বললেন, ঠাকুরপো, তোমার বুকিংটা এবার করে নাও। আর কতদিন তোমাকে আটকাব।
আমি আপত্তি করছিলাম, কিন্তু বৌদি কিছুতেই রাজী হলেন না। বললেন, না ভাই ঠাকুরপো, তুমি আর আমার সংস্পর্শে থেকো না। হয়তো আমার সংস্পর্শে থেকে এবার তোমারও কোন সর্বনাশ হবে।
দুদিন পর আমি দিল্লী রওনা হলাম। অনেক আপত্তি করা সত্ত্বেও বৌদি এয়ারপোর্টে এসে আমাকে বিদায় জানিয়ে গেলেন। প্রণাম করে বৌদির কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বৌদি আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমার দাদার স্মৃতি নিয়ে এই লণ্ডনেই থাকব, আর কোথাও গিয়ে আমি শান্তি পাব না। তুমি তাই আমাকে ভুলো না। মনে রেখো এই ঝড়ের রাতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই যে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। যন্ত্রচালিতের মত প্লেনে উঠে পড়লাম। বোয়িং ৭৩৭-এর তীব্র গর্জন আমার কানে এল না, বার-বার শুধু মনে পড়ল বিকট চিৎকার বৌদি ব্রেকফাস্ট দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
পালামের মাটিতে পা দিয়েই বৌদিকে আমার পৌঁছানো সংবাদ দিলাম। কদিন পর বৌদির একটা উত্তর পেলাম।
ভাই ঠাকুরপো,
তোমাকে প্লেনে চড়িয়ে দেবার পর জীবনে সব চাইতে প্রথম অনুভব করলাম, আমি নিঃসঙ্গ, আমি একা, বন্ধুহীন, প্রিয়হীন। অনুভব করলাম, আমার অন্তরের শূন্যতা। আজ মনে হচ্ছে স্বার্থপরের মতো তোমাকে ধরে রাখলেই ভাল হত; মনে হচ্ছে তোমার নির্মলদার জন্য যদি আর একজনকে চোখের জল ফেলার সঙ্গী পেতাম, তবে অনেক শান্তি পেতাম।
আজ বেশ বুঝতে পারছি কে যেন অলক্ষ্যে বসে আমার জীবনটা নিয়ে খুশীমত খেলা করছে। বেশ বুঝতে পারছি তারই ইচ্ছায় আমার মনের রং বদলায়। কখনো মেঘে-মেঘে ছেয়ে যায়, কখনো সোনালী রোদে ঝলমল করে ওঠে, আবার কখনো গোধূলির বিষণ্ণ রাঙা আলোয় ভরে যায়। আমি আর কিছুই ঠেকাবার চেষ্টা করি না, কিছুরই বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। আমার জন্য তুমি একটুও চিন্তা কোরো না। জীবন দেবতা যখন যেদিকে নিয়ে যাবেন, আমি নিঃশব্দে সেদিকেই যাব। তবে আমার সংস্পর্শে দুটি নিরপরাধ মানুষের সর্বনাশ হওয়ায়, আজ তোমার জন্য বড় ভয় হয়।
বাচ্চু, একদিন তারকার দীপ্তি আমারও ছিল, কিন্তু তবুও বিশাল আকাশের কোলে কেন ঠাঁই হলো না বলতে পার? বলতে পার কেন কক্ষচ্যুত তারকার মতো উল্কার জ্বালা বুকে নিয়ে ছুটে বেড়ালুম পৃথিবী ময়? বলতে পার কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে এজন্মে না হোক, অন্ততঃ আগামী জন্মে তোমার নির্মলদাকে পেতে পারি? ভালবাসা নিও।
তোমার অভাগা বৌদি।
২. তমাল দত্তকে চেনেন না
তমাল দত্তকে চেনেন না, এমন জীবিত কি মৃত কোন বাঙালী আছেন বলে অন্ততঃ আমি জানি না। কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে, হাওড়া হাটের ভীড়ে, হাজরা পার্কের মহতী জনসভায়, মহাজাতি সদনে, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে, টালিগঞ্জের ফিল্ম পাড়ায়, মোহনবাগান টেন্টে, ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম্যাচের ভীড়ে, তারকেশ্বরের মেলায় অথবা নিউ দিল্লী কালীবাড়ী বেঙ্গলী ক্লাবের বার্ষিক উৎসবে, বোম্বে শিবাজী পার্কে বাঙালীদের নববর্ষ উৎসবে বা মাদ্রাজে গৌড়ীয় মঠের কোন অনুষ্ঠানে, যে-কোন নারী-পুরুষকে জিজ্ঞাসা করুন, তমাল দত্তকে চেনেন?
আপনার এই প্রশ্ন করার জন্য ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা প্রথমে অবাক হয়ে আপনার দিকে তাকাবেন। তারপর বলবেন, চিনি না মানে? সে আমাদের ফ্যামিলী ফ্রেণ্ড। অর্থাৎ ভদ্রলোকের বিধবা মা, ভদ্রলোকের স্ত্রী, ভদ্রলোকের বিবাহিতা ও অবিবাহিতা বোন, ভদ্রলোকের ভাই, ছেলেমেয়ে সবার সঙ্গে তমাল দত্তের গভীর ভাব, গভীর ভালবাসা।
পুরী এক্সপ্রেসের থার্ড ক্লাশ কম্পৰ্টমেন্টে, দিল্লী মেলের এয়ার কণ্ডিসনড ফার্স্ট ক্লাশ কুপেতে বা এয়ার ইণ্ডিয়ার বোয়িং ৭০৭-এ বা বি-ও-এ-সি ভি-সি টেন-এ চড়ে পাশের বাঙালী যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন, তমাল দত্তকে চেনেন? আগের মতন ঠিক একই জবাব পাবেন। এমন ঘটনাও ঘটতে পারে যে, পিছনের সারি থেকে মিঃ রবার্টসন বললেন, ইউ আর টকিং অফ টমাল ডাটটা?
–দ্যাটস রাইট।
-হি ইজ এ গুড ফ্রেণ্ড অফ মাইন। একটু ঢোক গিলে মিঃ রবার্টসন একথাও বলতে পারেন ইন ফ্যাক্ট ডাটটা না এলে ইভনিং যেন ইভনিং-ই মনে হয় না।
কোয়ান্টাস ফ্লাইটে করাচী থেকে রোম যাবার পথে যদি কোনদিন মিস পেনসিলভেনিয়ার সঙ্গে দেখা হয় তবে জিজ্ঞাসা করবেন ঐ তমাল দত্তের কথা। দেখবেন, কি রোমান্টিকভাবে উত্তর দেয়।
এতবড় ভারতবর্ষটা একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিনবার ঘুরলাম। চমৎকার দেশ কিন্তু ইণ্ডিয়া উইদাউট ডাটটা ইজ হেল ফর মি।
লুফৎহান্সা ফ্লাইটে চড়ে জার্মানী বা ইউরোপ ঘুরতে-ঘুরতে মিস রোডকে পাশে পেলে আলাপ করবেন। আলাপটা একটু ঘন হলে জিজ্ঞাসা করবেন চেনেন নাকি আমাদের মিঃ ডাটটাকে? আপনাদের এদিকে তো বছরের অর্ধেক সময়ই থাকেন……
আমি বাজী রেখে বলতে পারি মিস রোড বলবেন, মাই গড! তুমি মার কাছে মাসীর গল্প করছ! মাইনে জের লিভে হের টামাল।