পনেরো দিন বাদে আম্মাকে প্রণাম করে নির্মলদা বি-ও-এ-সি-র প্লেনে কায়রো রওনা হলেন। তিন বছর বাদে কায়রো থেকে মস্কো বদলি হবার সময় একমাসের জন্য হোম লিভ পেয়েছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণা বিহীন হাওড়ার কোন টান না থাকায় দেশে আসেন নি। আবার তিন বছর মস্কোয় কাটালেন নির্মলদা। তারপর বদলি হলেন লণ্ডনে।
..জানিস বাচ্চু, তখন সবে লণ্ডন এসেছি। একদিন ইণ্ডিয়া হাউসের এক রিসেপশন থেকে ফেরার সময় অকস্মাৎ চ্যারিং ক্রশ টিউব স্টেশনে রাধার সঙ্গে দেখা। ওর বিয়ের আট বছর পরে ওকে লণ্ডনে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তোর বৌদি সে রাত্তিরে আর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরল না, আমার সঙ্গে এল। আট বছরের জমাট বাঁধা ইতিহাস দুজনে দুজনের কাছে তুলে ধরলাম। হাওড়ার সঙ্গে কোন যোগাযোগ না থাকায় আমি কিছুই জানতাম না, জানতাম না বিয়ের দেড় বছর বাদে জীপ দুর্ঘটনায় সুকুমারবাবু মারা গেছেন। বিধবা হবার পর তোর বৌদির কোন প্রতিবন্ধক এল না। বাবা, মা, আম্মা সবাই মত দিলেন। থাক, বিলেতে গিয়েই পড়াশুনা করুক। তারপর একদিন ও লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে পাস করে বেরুল। তারপর দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দুজনে মিলে অনেক ভেবেছি, অনেক আলোচনা করেছি, অনেক কথা বলেছি, অনেক কথা শুনেছি। শুধু কি তাই? দুজনে মিলে অনেক চোখের জল ফেলেছি। রিজেন্ট পার্কের বেঞ্চগুলো আজও সে চোখের জলে ভিজে আছে। ভাবতে ভাবতে কোন কূল-কিনারা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দুজনে ঘর বেঁধেছি, আর এই তিনটি বছর স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করে চলেছি দুজনে।
নির্মলদা একটা পাঁজরকাঁপানো দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বৌদিও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। হয়তো আমারও একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়েছিল কিন্তু ঠিক মনে নেই।
…যাকে সারা জীবন ধরে নিজের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছি, যার রক্তের সঙ্গে নিজের রক্ত মিশিয়ে সন্তানের হাসিমুখ দেখবার ছবি এঁকেছি মনে মনে, তাঁকে নিয়ে এই অভিনয় করা যে কি অসহ্য, সে কথা তুই বুঝবি না বাচ্চু।
উত্তেজনায় আমার হাতটা চেপে ধরলেন নির্মলদা। বললেন, বিশ্বাস কর বাচ্চু, আজ আর তোর কাছে মিথ্যা বলব না।…মাকে মাঝে সমস্ত ন্যায়-অন্যায়ের কথা ভুলে গিয়ে রাতের অন্ধকারে তোর বৌদির ঘরে ঢুকে পড়েছি। দু-একদিন হয়তো হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছি, কিন্তু তারপর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছি নিজের ঘরে। কখনও কখনও আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর তোর বৌদি চুরি করে আমার পাশে শুয়ে থেকেছে, আমাকে আদর করেছে, আমার মুখে মুখ রেখে কেঁদেছে, কিন্তু তবুও আজ পর্যন্ত তার বেশী এগুতে পারিনি।
নির্মলদা হাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আর কিছু বলতে পারলেন না, থেমে গেলেন। চোখের জলটা মুছতে মুছতে বৌদি বললেন, ঠাকুরপো একটা কথা বলব?
আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না। মাথা নেড়ে বললাম, বলুন।
তোমার দাদাকে আর আমাকে খুব খারাপ মনে হচ্ছে, তাই না?
তুমি কি ভেবেছ বৌদি, আমি ভাটপাড়ার পণ্ডিত, না কি পাষাণ? একটু থেমে মুখে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম, আমাকে আরো একটু দুঃখ না দিলে তুমি বুঝি তৃপ্তি পাচ্ছ না বৌদি?
বৌদি নির্মলদার ওপাশ থেকে উঠে এসে আমার চোখের জল মুছিয়ে নিলেন। বললেন, লক্ষ্মীটি ঠাকুরপো, দুঃখ কোরো না। তুমি যে আমাদের জন্য চোখের জল ফেলছ, তাতেই আমাদের অনেক দুঃখ কমে গেছে। তাছাড়া তুমি ভিন্ন আর কেউ তো আমাকে এমন করে বৌদি তাকেনি, এমন মর্যাদা তো আর কেউ দেয়নি, আমি তো আর কাউকে এমনভাবে ঠাকুরপো বলে ডাকবার অধিকার পাব না, তাই তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
বৌদির হাতটা চেপে ধরে বললাম, ছি, ছি, বৌদি, এ কি কথা বলছ?
পরের দিন নির্মলদা আর কাজে বেরুলেন না, আমিও আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো বাতিল করে দিলাম। লাঞ্চের পর তিনজনে অক্সফোর্ড স্ট্রীটে মার্কেটিং করে কাটালাম সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা। রাত্তিরে পিকাডিলীর ধারে একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার খেয়ে হাইড পার্ক কর্নারে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম।
রাত্রে ফিরে এসে নির্মলদা দেখলেন বিকেলের ডাকে একটা প্লেন কোম্পানির লণ্ডন-মন্ট্রিলের উদ্বোধনী-যাত্রার অতিথি হবার আমন্ত্রণ এসেছে। নির্মলদা বললেন, বাচ্চু তুই কটা দিন থেকে যা, আমি ঘুরে এলে দিল্লী যাস।
পরের দিন আমি আমার এডিটরকে একটা টেলিগ্রাম করে জানালাম, লণ্ডন ডিপারচার ডিলেড স্টপ রিচিং ডেলহি নেক্সট উইক।
তিনদিন পর রাত দশটার সময় আমি আর নির্মলাবৌদি নির্মলদাকে লণ্ডন এয়ারপোর্টে বিদায় জানিয়ে এলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। দুজনেই বেশ ক্লান্ত ছিলাম। টেলিভিশনের সামনে বসে গল্প না করে দুজনেই শুয়ে পড়লাম, লেট নাইট নিউজটাও শুনলাম না।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে খবরের কাগজটা খুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বৌদি একটা বিকট চিৎকার করে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। আমি মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম। বৌদির মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে দেখি জ্ঞান নেই। তাড়াতাড়ি ফ্রিজ থেকে কয়েক বোতল ঠাণ্ডা জল এনে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে দিতে খবরের কাগজের পর নজর পড়তেই দেখলাম, যে প্লেনে নির্মলদা রওনা হয়েছিলেন, সে প্লেন লণ্ডন থেকে টেকঅফ করার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে অতলান্তিকের গভীর গর্তে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্লেনের কয়েকটা টুকরো পাওয়া গেছে, কিন্তু একটি যাত্রীরও সন্ধান পাওয়া যায়নি।