সেই যে–নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
বৌদি কোন উত্তর দিতেন না, শুধু ভাব-ভরা চোখে একবার চাইতেন নির্মলদার দিকে। তারপর গাইতেন গান।
কবে কখন ও কেন বৌদিকে তুমি বলে ডাকতে আরম্ভ করেছিলাম, তা আজ মনে নেই। মনে আছে শুধু সেই কটি দিনের স্নেহভরা মধুর স্মৃতি। নির্মলদার ঔদার্য ও বৌদির স্নেহে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ওদের দুটি জীবনের মাঝে আমিও আমার একটা ঠাঁই খুঁজে পেলাম।
কদিন থাকার পরই জানতে পারলাম বৌদির নাম কৃষ্ণা। একদিন রাত্তিরে কথায়-কথায় হঠাৎ নির্মলদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বৌদিকে রাধা বলে ডাকেন কেন?
কেন আবার? পরস্ত্রীকে তো এর চাইতে ভাল নামে ডাকা যায় না।
মুহূর্তের মধ্যে বৌদির মুখটা লাল হয়ে উঠল, দুজনের দৃষ্টি বিনিময়ও হলো। আমি এসব নজর করেছিলাম, কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। বৌদির সিথিতে সিঁদুর দেখিনি। তবে তার জন্য আশ্চর্য হইনি, কারণ লণ্ডনপ্রবাসী কোন মেয়েই সিঁদুর পরে না বললেই চলে।
বছর দেড়েক পর রাষ্ট্রপতির ব্রিটেন-সফর কভার করার জন্য আমি লণ্ডন গেলাম। রাষ্ট্রপতির সফর শেষে কদিন নিরিবিলি লণ্ডনবাস করার জন্য আমি আবার হেণ্ডন সেন্ট্রালে নির্মলদার ফ্ল্যাটে বৌদির সংসারে আশ্রয় নিলাম। সেবার একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম। ড্রয়িংরুমে রাত্তিরের গানের আসর ভাঙার পর দুজনকে দুটি ঘরে চলে যেতে দেখলাম। গভীর রাতে চুরি করেও দেখেছি, দেখেছি দুজনকে দুঘরে গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকতে। মনে একটু খটকা লেগেছিল। কিন্তু সেটা নিতান্তই খটকা, তার বেশী কিছু নয়। ইতিমধ্যে বৌদি নির্মলদার স্ত্রী বলে আমি তার নাম দিলাম নির্মলা। ডিনার টেবিলে এই নামকরণ-উৎসবের সময় দুজনেই একটু মুচকি হেসেছিলেন। বোধকরি এই নামকরণ-উৎসবের পরই নির্মলদা ও নির্মলাবৌদি স্থির করেছিলেন, আর দেরি করা ঠিক নয়। তাই তো রাত্তিরে ফায়ার-প্লেসের ধারে বসে নির্মলদা ওঁদের দুজনের অতীত জীবন-কাহিনী শুনিয়েছিলেন।
হাওড়া মধুসূদন পালচৌধুরী লেনে নির্মলদা ও নির্মলাবৌদিদের বাড়ী প্রায় পাশাপাশি। দুটি পরিবারের মধ্যে গভীর হৃদ্যতাও ছিল। শৈশবে নির্মলদার মা মারা গেলে কিছুকাল বড়পিসির তদারকেই ছিলেন। বড়পিসির বিয়ে হবার পর নির্মলদার জন্য তার বাবা বড়ই চিন্তায় পড়লেন। তখন নির্মলাবৌদির ঠাকুমা বললেন, আরে, এর জন্য আবার চিন্তা কি? ও আমার কাছেই থাকবে।
তখন নির্মলদার বয়স আট কি নয় হবে। পরে নির্মলদাদের সংসারে তাঁর কাকিমা এসেছিলেন, কিন্তু এই মাতৃহীন শিশুটি সম্পর্কে তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না। নির্মলদা ঐ ঠাকুমার স্নেহছায়ায় থেকে গেলেন। স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকলে নির্মলদা নিজেদের বাড়িতে থাকলেও আত্মার যোগাযোগটা কমল না। দুনিয়ার সবাই শুধু এইটুকুই জানত, কিন্তু কেউ জানত না ঐ অতগুলো মানুষের ভীড়ের মধ্যেও দুটি আত্মা সবার কল-কোলাহল থেকে বহুদূরে নিজেদের একটা ছোট্ট দুনিয়া রচনা করেছে। রিপন কলেজ থেকে ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে পাস করার পর নির্মলদা ইকনমিক্সে এম-এ পড়বার জন্য ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলেন। মাস ছয়েক পরে হাওড়া ব্রীজের কোণায় এক দুর্ঘটনায় নির্মলদার বাবা মারা গেলেন। ঠাকুমার স্নেহের স্পর্শে ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভালবাসায় সে-দুঃখও নির্মলদা ভুলেছিলেন। কিন্তু রেজাল্ট খুব ভাল হলো না, সেকেণ্ড ক্লাস পেলেন।
এদিকে রেজাল্ট বেরুবার আগে থেকেই নির্মলদা পাড়ার দত্তদার সূত্রে ডেইলি টাইমস পত্রিকায় যাতায়াত শুরু করেছিলেন। রেজাল্ট বেরুবার পর পাকাপাকিভাবে রিপোর্টারের কাজে লেগে পড়লেন।
তিন বছর পর নির্মলাবৌদিও বি-এ পাস করলেন, কিন্তু বাড়ির কেউ এম-এ পড়াতে চাইলেন না। সবাই বললেন, আরো পড়লে ভাল পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে। পাত্র নির্বাচন-পর্ব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এলে নির্মলদা আর দেরি করলেন না। একদিন একটু আড়ালে ঠাকুমাকে বললেন, আম্মা, এ বিয়ে দিও না। কিনু সুখী হবে না।
ঠাকুমা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন রে?
ঠাকুমার বিশেষ আপত্তি ছিল না, কিন্তু নির্মলাবৌদির মা কিছুতেই রাজী হলেন না। স্ত্রীর চাপে পড়ে নির্মলাবৌদির বাবাও আপত্তি করলেন। নির্মলাবৌদি অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন কিন্তু কিছু ফল হয়নি। বন্ধু-বান্ধব নির্মলদাকে পরামর্শ দিয়েছিল নির্মলাবৌদিকেও নিয়ে বম্বে বা দিল্লী মেলে চেপে পড়তে, কিন্তু নির্মলদা রাজী হননি। শুধু বলেছিলেন, তা হয় না রে। যাদের দয়ায় আমি এতদূর এসে পৌঁছেছি, তাদের সর্বনাশ করা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।
পরবর্তী সাতাশে শ্রাবণ মাঝরাতের এক লগ্নে এঞ্জিনিয়ার সুকুমারবাবুর সঙ্গে নির্মলাবৌদির বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে বাড়ির রোশনাই আলোর চেকনাইতে কেউ জানল না দুটি আত্মা জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
নির্মলাবৌদি সুকুমারবাবুর হাত ধরে হাজারিবাগ রওনা হবার কয়েকদিনের মধ্যেই নির্মলদা ছুটি নিয়ে বম্বে রওনা হয়ে গেলেন। বম্বের ডেইলি এক্সপ্রেসের এডিটর মিঃ রঙ্গস্বামীর সঙ্গে একবার একটা প্লেনের উদ্বোধনী-যাত্রায় একত্রে জাপান গিয়েছিলেন। নির্মলদাকে তার বেশ ভাল লেগেছিল এবং একটা ভাল অফারও দিয়েছিলেন। তখন সে-অফার নেওয়া নির্মলদার পক্ষে সম্ভব হয়নি কিন্তু অতীতের সেই সূত্র ধরেই আজ উনি বম্বে গেলেন। সপ্তাহ খানেক বম্বে থাকার পর মিঃ রঙ্গস্বামী জানালেন, দিল্লী বা বম্বেতে কোন ওপেনিং নেই, তবে কায়রোতে স্পেশাল করেসপনডেন্টের পোস্টটা খালি আছে। নির্মলদা হাসিমুখে সে অফার গ্রহণ করে পনেরো দিনের জন্য কলকাতা ফিরে এলেন।