বেলগ্রেডে যখন নির্মলদার সঙ্গে দেখা হলো, তখন উনি লণ্ডনে পোস্টেড। তাই লণ্ডন যাবার পথে আমি নির্মলদার সহযাত্রী হলাম। পথে কদিনের জন্য দুজনেই বার্লিন গেলাম। কেম্পিনিস্কি হোটেলে দুজনে একই ঘরে ছিলাম। দীর্ঘদিনের পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুজনের একত্রে বার্লিন বাস এক বিচিত্র গাঁটছড়া বেঁধে দিল আমাদের মধ্যে। দুটি মানুষের মধ্যে পরমাত্মীয়ের সম্পর্ক গড়বার জন্য সতেরো দিন মোটেই দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু অত্যন্ত নিবিড় করে মেশবার জন্য আমার আর নির্মলদার মধ্যে এক প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। তাই তো বার্লিন ত্যাগের আগের দিন নির্মলদা হঠাৎ আমাকে বললেন, বাচ্চু, তুই তোর লণ্ডনের হোটেল রিজার্ভেশন ক্যানসেল করে একটা টেলিগ্রাম করে দে।
একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, কেন নির্মলদা?
কেন আবার? তুই আমার কাছেই থাকবি।
হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে টেলিগ্রামটা দেবার সময় নির্মলদাও একটা টেলিগ্রাম পাঠালেন। কাকে, কোথায়, কিজন্য পাঠালেন, তা বুঝতে পারলাম না। ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে লণ্ডন পৌঁছবার পর জেনেছিলাম ঐ টেলিগ্রামটা নির্মলাবৌদিকে পাঠিয়েছিলেন।
লণ্ডন এয়ারপোর্ট কাস্টমস থেকে বেরিয়ে আসতেই একজন সুদর্শনা মহিলা ধীর পদক্ষেপে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে নির্মলদার হাত থেকে টাইপরাইটার আর কেবিন-ব্যাগটা নিয়ে নিলেন। তারপর কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে, টানা চোখ দুটোকে একটু কুঁচকে নির্মলদার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, তুমি কি কোনদিন আমাকে শান্তি দেবে না?
সামনের দিকে এগোতে এগোতে একটু হেসে অবাক হয়ে নির্মলদা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কেন বল তো?
আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? আজকে তোমার ফেরার কথা?
কেন, টেলিগ্রাম পাওনি?
নিশ্চয়ই, একশোবার পেয়েছি, কিন্তু তোমার না সোমবার আসার কথা?
একগাল হাসি হেসে নির্মলদা বললেন, ও, এই কথা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এই কথা।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম সোমবার নির্মলদার লণ্ডন ফেরার কথা ছিল এবং কদিন যে দেরী করে আসছেন, সে খবরও জানাননি। স্বাভাবিকভাবেই বৌদির সেজন্য চিন্তা হয়েছে। ট্যাক্সির কাছে এসে নির্মলদার খেয়াল হলো আমার সঙ্গে বৌদির পরিচয় করিয়ে দেননি। বৌদির ডান হাতটা টেনে ধরে বললেন, রাধা, তোমার সঙ্গে বাচ্চুর পরিচয় করিয়ে দিইনি।
নির্মলদার দিকে ফিরে বৌদি বললেন, সে-সব কাণ্ডজ্ঞান কি তোমার আছে? এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, এস ভাই, ট্যাক্সিতে ওঠো।
তিনজনে ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সির মধ্যে আমাদের অনেক কথা হয়েছিল, সে-সব আর আজ মনে নেই। তবে মনে আছে বৌদি একবার বাঁকা চোখে নির্মলদার দিকে তাকিয়ে পরে আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিয়ে করেছ?
না বৌদি।
বিয়ে কোরো না।
কেন বলুন তো?
কেন আবার? বিয়ে করলে তো আমারই মতো তাঁকেও যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।
উত্তর-পশ্চিম লণ্ডনের হেণ্ডন সেন্ট্রালে নির্মলদার ফ্ল্যাটে আমার দিন গুলো বেশ কাটছিল। এত ভাল আমি কাটাতে চাইনি, কিন্তু অদৃষ্টের যোগাযোগে এড়াতে পারিনি। হিসাব-নিকাশে ভগবানের ভুল নেই; সেদিনের সব আনন্দের জের সুদে-আসলে তিনি আজ আদায় করছেন। কিন্তু আমি অসহায়।
নির্মলদা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যেতেন। আমি তিনবার বেড-টি খেয়েও উঠতে চাইতাম না। বৌদি কাজকর্মের ফাঁকে-ফাঁকে এক একবার হাঁক মারতেন, ঠাকুরপো, উঠুন ভাই। অনেক বেলা হয়ে গেল। আমি কোন জবাব না দিয়ে বালিশটাকে আরো একটু আদর করে জড়িয়ে পাশ ফিরে শুতাম। শেষকালে বৌদি এসে ধাক্কা দিতে শুরু করতেন। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর আমি পাশ ফিরে জিজ্ঞাসা করতাম, কিছু বলছেন?
চোখের কোণে হাসি ফুটিয়ে, মুখের চারপাশে গাম্ভীর্যের ভাব এনে বৌদি বলতেন, বাপরে, বাপ, তোমরা এত ঘুমোতেও পার!
সকালবেলায় উঠতে না উঠতেই বহুবচন দিয়ে গালাগালি দিতে শুরু করলেন। তারপর বৌদির মুখটা কাছে টেনে নিয়ে কানে-কানে ফিস ফিস করে বলতাম, কেন, নির্মলদারও বুঝি খুব বেশি ঘুম?
চট করে বৌদি মুখটা টান দিয়ে বলতেন, বাচ্চু! কানটি মলে দেব।
উইথ প্লেজার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
বৌদি আমার কথায় কান না দিয়ে উঠে যেতে গেলেই আমি তার শাড়ির আঁচল ধরে টান দিয়ে কাছে টেনে নিতাম।
জানেন তো বৌদি, প্রাইম মিনিস্টারকেও রিপোর্টারের প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।
বৌদি বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা দেখিয়ে বলতেন, রেখে দাও তোমাদের রিপোর্টারী চালিয়াতি। মাঝে দুবছর ছাড়া আজ আঠারো বছর ধরে রিপোর্টার দেখছি। ওসব ভয় আমাকে দেখিও না।
শেষ পর্যন্ত দুজনেই মিটমাট করে নিতাম। বৌদি একটা গান শোনালেই আমি উঠে পড়তাম।
কাজ কর্ম সেরে আমার ফিরতে রাত হত, কিন্তু নির্মলদা সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসতেন। খুব জরুরী কাজ না থাকলে সন্ধ্যার পর কোনদিন তিনি বেরুতেন না।
আমি ফিরলে তিনজনে একসঙ্গে ডিনার খেতে বসতাম। খেতে বসে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের আলোচনা শেষ করে উঠতে উঠতে অনেক রাত হতো। কিন্তু তখনও আমাদের আসর ভাঙত না। ফায়ার প্লেসের ধারে আমরা দুজনে সিগারেট টানতাম, আর বৌদি শোনাতেন গান। একটা নয়, দুটো নয়, ডজন-ভজন গান গাইতেন বৌদি। এত গান শোনার পরও হয়তো নির্মলদা বলতেন, রাধা, সেই গানটা শোনাবে?
কোন্ গান?