কোনমতে সামলে নিয়ে ডাক্তার জবাব দিল, না, কিছু না। এত গুলো সুন্দর পোর্ট্রেট দেখে চমকে না উঠে কি করি বলুন!
পোর্ট্রেটগুলো নেবার আগে ডাক্তার শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল আচ্ছা ধরুন, যদি কোনদিন আপনার কবিতার দেখা পাই, আর তাকে যদি একটা পোর্ট্রেট দিতে হয়, তবে কোনটা দিলে আপনি সুখী হবেন?
ডক্টর, যদি কোনদিন কবিতার দেখা পাও তবে সে ভারটা তাকেই নিতে বোলো।
ডাক্তার মুখাজী ধীর পদক্ষেপে প্রস্থান করলেন।
অলক তাঁর শূন্য মন্দিরে ফিরে এসে প্রায় উন্মাদের মতো চীৎকার করে কেঁদে উঠল।
০৩.
জানেন বাচ্চুদা, আপনার বিনয় ডাক্তার আমার অতগুলো পোট্রেট নিয়ে আসতেই হঠাৎ আমার মাথায় বজ্রাঘাত হলো। অতীত বর্তমানের সমস্ত স্মৃতি যেন আমাকে উন্মাদ করে তুলল। সেদিন যে কিভাবে নিজেকে সংযত রেখেছিলাম, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন, আর কেউ না।
অনেক রাত হয়েছিল। হাউস বোটের ছাদে বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। কিন্তু তবুও দুজনের কেউই নড়তে পারলাম না।
রত্না আঁচল দিয়ে আর একবার চোখের জল মুছে নিল। বলল, আপনার ডাক্তার বিন্দুমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ করল না। কিন্তু দিন কতক আগে আমার উরুর অপারেশন নিয়ে আলাপ-আলোচনা আর সেদিনের পোর্ট্রেট আনার সঙ্গে আমার চোখের সামনে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠল। যথারীতি ডিনার খেতে বসলাম দুজনে। আমার গলা দিয়ে কিছু নামতে চাইছিল না। ডাক্তার কিন্তু অন্য দিনের চাইতে সেদিন অনেক বেশী খেয়েছিল। অন্য দিন একটার বেশী ফিশ ফ্রাই খায় না, সেদিন আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিন তিনটে খেলো। দুবার করে ভাত আর মাছ চেয়ে নিল।
রত্নার গলা দিয়ে আর স্বর বেরুচ্ছিল না। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম কিন্তু তবুও ওঁকে কিছু বলতে পারলাম না।
এক কাশল, একটু চোখের জল মুছে নিয়ে আবার শুরু করল, আজ আর আপনার কাছে কিছু গোপন করব না। সব কিছু বলে কিছুটা হালকা হতে চাই।
রত্নার মন হাল্কা হয়েছিল কিনা জানিনা। তবে বলেছিল, ডাক্তার সে রাত্রে ওকে অনেক আদর করেছিল, ভালবাসায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। সমস্ত মন প্রাণ নিয়ে চরম আনন্দ দিতেও কার্পণ্য করেনি। তারপর দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রত্নার চোখে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি। কিন্তু বিধাতা পুরুষের বিধান কে খণ্ডাবে। শেষ রাত্রিরের দিকে সর্বনাশা ঘুম তাকে গ্রাস করল।
অন্য দিনের চাইতে পরের দিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল রত্নার। হাসপাতালে ডাক্তারের ডিউটি আটটা থেকে। সাড়ে সাতটার মধ্যে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে রওনা হয়। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে দেখে চমকে উঠল রত্না। কিন্তু ডাক্তারকে তখনো ঘুমিয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ যেন আঁতকে উঠল!
রত্না আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাচ্চুদা, একটু পরে একটু নাড়া চাড়া করতেই দেখলাম সব কিছু শেষ। পাশে দেখি স্লিপিং পিলের দুটো খালি শিশি পড়ে আছে। বালিশের তলায় একটা চিঠি পেয়েছিলাম……
রত্না, আমি যাচ্ছি, দুঃখ কোনো না। তোমাকে আমি ভালবেসেছি, কিন্তু সে ভালবাসা স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা। তার বেশী কিছু নয়। তুমি যাঁর কবিতা, সেই অলক আর তোমার সারা মনকে বঞ্চনা করে রত্নাকে উপভোগ করার কোন অধিকার আমার নেই।
রত্না, আমি যাচ্ছি, আবার তোমার কাছে ফিরে আসব। তবে আগামী জন্মে নয়। আগামী জন্মে তুমি নিশ্চয়ই অলককে পাবে। তার পরের জন্মে আমি আসব তোমার কাছে।
আমার জন্য তুমি চোখের জল ফেলো না। আমি তো তবুও কটি বছর তোমার ভালবাসা পেয়েছি, তোমাকে উপভোগ করেছি, সুখে দুঃখে তোমাকে পাশে পেয়েছি। দুঃখ হয় সেই সর্বত্যাগী শিল্পীর জন্য, যে তোমার ভালবাসার জ্বালা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা পৃথিবীময় আর শুধু তোমার ছবি এঁকে দিন কাটাচ্ছে।
আর হ্যাঁ, অলক যাবার আগে আমাকে দুটি বিশেষ অনুরোধ করেছিল। তার একটি আমি রক্ষা করার সময় পেলাম না। ওর বড় আদরের ময়নাকে একটু দেখো আর অলকের হয়ে একটু আদর কোরো।
ভগবান তোমার সহায় হোন।
তোমার বিনয়