কোন সাড়া পেলাম না। মুহূর্তের জন্য আমার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল, মনে হলো মাটিটা কাঁপছে, চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো, কবিতাকে বাঁচাতে হবে। ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে একটু ভাল করে নজর করতে দেখলাম জ্ঞান নেই। আর দেখলাম সারাটা কাপড় রক্তে ভিজে উঠেছে। দুএক মিনিটের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম একটা মোটা ডাল ওর উরুতে কয়েক ইঞ্চি ঢুকে গেছে আর সেখান দিয়ে রক্ত বইছে।
অলক সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতির কথা স্মরণ করে ভয়ে-আতঙ্কে শিউরে উঠল। ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরে বলল, আমি আর বিন্দু মাত্র দ্বিধা না করে ডালটাকে টেনে বের করলাম। ওর শাড়ীর আঁচল ছিঁড়ে ওখানে একটা ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিলাম।
ডাক্তার এতক্ষণ মুখ বুজে শুধু শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, তারপর?
তারপর ওকে নিয়ে গেলাম দিল্লীর উইলিংডন হাসপাতালে। এমার্জেন্সীতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তাররা দল বেঁধে ঢুকল অপারেশন থিয়েটারে। অনেকক্ষণ ধরে অপারেশন হলো। সতেরোটা ষ্টিচ করতে হয়েছিল।
ডাক্তার মুখার্জী একটু চমকে উঠলেন, ভ্রূ দুটোও কুঁচকে উঠল।
অলক বলল, শুধু শুনেই ঘাবড়ে যাচ্ছো ডক্টর! আর ভেবে দেখো তো আমার সেদিনের অবস্থা।
অলকের চোখের পর থেকে ডাক্তার দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিল। মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে কি যেন চিন্তা করে নিল।
অলক বলেছিল, তারপরের কাহিনী বিস্তারিতভাবে বলে লাভ নেই। শুধু জেনে রাখ, পূর্ণিমা আর মামা-মামীমার অসীম কৃপায় কবিতা ভাল হয়ে উঠল আর আমরা দুজনেই অনেক অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেলাম! কবিতা যখন এলাহাবাদ ফিরে গেল, তখন ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। দিল্লীর রিজ-এর কাহিনী, অপারেশনের খবর কেউ জানল না। পূর্ণিমা আর ওর মামা-মামী ছাড়া কবিতার অপারেশনের খবর আজো কেউ জানে না।
পৃথিবীর অসংখ্য প্রেমের কাহিনীর মতো অলক-কবিতার প্রেম বাস্তবে সাফল্য লাভ করেনি। একটা সামান্য আর্টিষ্টের সঙ্গে যে কবিতার বিয়ে হওয়া অসম্ভব, সে কথা অলককে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন ওর বাবা, দাদা। এতদিন যে কথা, যে কাহিনী এলাহাবাদের কেউ জানত না, হঠাৎ এতদিন পরে সে কাহিনী জর্জ টাউন, টেগোর টাউন, কটরা, সিভিল লাইন্সের সব বাঙ্গালী মহলে ছড়িয়ে পড়ল।
কবিতা-বিহীন জীবনে অলক সহ্য করতে পারেনি এই অপমানের ঝড়। একদিন গভীর রাতে ময়না ঘুমিয়ে পড়ার পর অলক দেশত্যাগী হলো।
জানো ডাক্তার, আর একবার দিল্লী দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করল। তাই সব চাইতে প্রথম এলাম সেখানে। রিজ-এর চারপাশে, উইলিংডন হাসপাতালের পাশে-পাশে ঘোরাঘুরি করে কিছুটা চোখের জল ফেলে কবিতার উদ্দেশ্যে আমার শ্রদ্ধা জানালাম, তার ভালবাসার স্মৃতি রোমন্থন করে অনেক দুঃখের মধ্যেও নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেলাম। শেষ দিন পূর্ণিমার মামা-মামীকে প্রণাম করে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিলাম।
অলকের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিল। গলার স্বরটা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তবুও থামল না।
মা, ময়না আর কবিতা এই তিন জনের তিনটি ছবি আর মাত্র দশটি পাউণ্ড সম্বল করে চড়ে পড়লাম প্লেনে। এলাম তেহেরান। তেহেরান থেকে বাগদাদ, বাগদাদ থেকে কায়রো, কায়রো থেকে আথেন্স, তারপর রোম, জুরিখ, জেনেভা, ফ্রাঙ্কফার্ট, প্যারিস ও সব শেষে এই হতচ্ছাড়ার দেশে। নমাস ধরে ঘুরেছি এইসব দেশে। যে কবিতাকে আমি পেলাম না আমার জীবনে, সেই কবিতার অসংখ্য পোর্ট্রেট এঁকেছি। জীবন ধারণের জন্য সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে সে সব পোর্ট্রেট দিয়ে এসেছি ঐসব দেশের সম্ভ্রান্ত মানুষের হাতে। আমার ঘরে আমি কবিতাকে কোন মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলাম না, তাইতো মর্যাদার সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠা করে এলাম অসংখ্য মানুষের সংসারে।
প্রায় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল অলক। তবুও বেশ খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, এখানে এসেও কবিতার পোর্ট্রেট একেছি; একটি নয় দুটি নয়, অনেকগুলি। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে আজ আর তার পোর্ট্রেটগুলো কাউকে দিতে পারব না।
একটু চুপ করল অলক। শেষে বলল, ভাই ডক্টর, এই দেশেও আমার মন টিকছে না। কয়েকদিনের মধ্যেই ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডা চলে যাচ্ছি। ডাক্তার মুখার্জীর হাতটা চেপে ধরে বলল, ডক্টর, বোধহয় তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। এ ফাঁদে আমি আর পা দেবো না। তাই তোমার সঙ্গেও আর বিশেষ যোগাযোগ রাখব না বা রাখতে পারব না। তবে কানাডা যাবার আগে তোমার হাতে আমার কবিতার পোর্ট্রেটগুলো দিয়ে যাব। একটু মর্যাদার সঙ্গে ওগুলো রক্ষা কোরো।
এবার ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আর একটা শেষ অনুরোধ আছে তোমার কাছে। যদি কোনদিন কবিতার দেখা পাও বোলো, আমি আজও ভুলতে পারিনি তাকে। বোলো, আজও বোধহয় আমি তাকে ভালবাসি। সে আর তার স্বামী যেন আমাকে ক্ষমা করে। ডক্টর! আর যদি কোনদিন কোন কারণে সুযোগ আসে তবে আমার ময়নার একটু খোঁজ কোরো, একটু আদর কোরো আমার হয়ে।
ডাক্তার আর অলক দুজনেই চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় নিল সে রাত্রে। দিন তিনেক পরে অলক তার গোল্ডর্স গ্রীনের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিল ডাক্তারকে। কবিতার পোর্ট্রেটগুলো দেখে ডাক্তার যেন ভূত দেখার মতো আঁতকে চমকে উঠেছিল। অলক জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হলো ডক্টর?