পরবর্তী কিছুকাল অফিস ছাড়া অলক বাকী সময়টুকু কাটিয়েছে কবিতার পোর্ট্রেট দেখে, তাদের সঙ্গে কথা বলে, গান গেয়ে, আর পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে। মন কিন্তু এইখানেই স্থির হতে পারেনি, সে আরো এগিয়ে গেছে। মন চেয়েছে সমস্ত কিছু দিয়ে কবিতাকে গ্রহণ করতে, তাকে প্রাণের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে দেহের প্রতিটি সত্ত্বা, প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে।
মন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে তো দুনিয়া চলে না। মনের হুকুম মেনে চললে দুনিয়াটা হয়তো আরো সুন্দর, আরো মনোরম হতো। কিন্তু তা হয়নি। হবারও নয়। অলকের সে উপলব্ধি হলে আর সহ্য করতে পারেনি, কবিতার পোর্ট্রেট ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেছে। সারারাত্তির কেঁদেছে। সারাদিন কেঁদেছে।
বেশীদিন আর এমনি ভাবে কাটাতে পারেনি। অফিস ফেরার পথে কোনদিন বড় একটা বোতল সঙ্গে এনেছে। দেবদাসের মতো ঢক ঢক্ করে গিলেছে সে বিষ। মাতাল হয়ে ভুলতে চেয়েছে কবিতাকে। পারেনি। বরং আরও মনে পড়েছে। মনে পড়েছে এলাহাবাদ টেগোর সোসাইটিতে গান গাইবার কথা। কবিতা হারমোনিয়াম বাজিয়েছিল আর অলক গেয়েছিল, আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে, আমি তোমায় সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে।
বোতলের শেষটুকু পর্যন্ত খেয়েছে। ভেবেছে তাল সামলাতে পারবে না। অজ্ঞান-অচৈতন্য হয়ে বাকি রাতটুকু সমস্ত অতীত স্মৃতি ভার থেকে মুক্ত থাকবে। সব হিসাব-নিকাশ উল্টে-পাল্টে গেছে।
বন্ধুহীন, প্রিয়হীন অলকের দিন এইভাবেই কাটছিল। পরে বিধাতা পুরুষের অসীম কৃপায় ডুরী লেন থিয়েটারের পাশের একটা ছোট্ট গলির মধ্যে একটা পাবে অপ্রত্যাশিতভাবে আলাপ হলো ডাঃ মুখার্জীর সঙ্গে। প্রায় প্রথম দর্শনেই অলককে ভাল লেগেছিল ডাক্তারের। ভাবভোলা উদাস নিঃসঙ্গ ব্যর্থ প্রেমিক শিল্পীকে কার না ভাল লাগবে? ডাক্তারের মধ্যে সমবেদনশীল দরদী মনের স্পর্শ পেয়ে অলক প্রায় কৃতার্থ হয়েছিল।
রোজ সম্ভব হতো না, কিন্তু প্রায়ই দুজনে মিলত। কোন দিন কোন পাবে এক জাগ বিয়ার নিয়ে, কোনদিন চিপস খেতে খেতে ভিক্টোরিয়া এম্বব্যাঙ্কমেন্টে হাঁটতে হাঁটতে, কোনদিন আবার মার্বেল আর্চের পাশে বা হাইড পার্কের কোণায় বসে বসে দুজনে গল্প করেছে, আড্ডা দিয়েছে। অলকের আহত মন ডাক্তারের ভালবাসার ছোঁয়ায় মুগ্ধ হয়েছিল। শুদু তাই নয় একদিন এক দুর্বল মুহূর্তে উজাড় করে দিয়েছিল নিজের স্মৃতি, বলেছিল কবিতাকে ভালবাসার ইতিহাস আর তার ব্যর্থতার কাহিনী।
জানো ডক্টর, বাবা নিজে ওস্তাদ ছিলেন বলে তিনি চাইতেন আমি গান শিখি, ওস্তাদ হই, তাঁর ঐতিহ্য, তাঁর ধারা রক্ষা করি। ছোট বেলায় বাবার কাছেই গান শিখেছি। সবাই বলতো আমার নাকি ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমার কিন্তু মন বসতো না। আমি চাইতাম ছবি আঁকতে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই বাবা মারা গেলেন। আর আমার গানের চর্চাও বন্ধ হলো। ভর্তি হলাম বোম্বে, জে, জে, স্কুল অফ আর্টস-এ।
সেকেণ্ড ইয়ারে পড়বার সময় মা মারা গেলেন। ছুটিতে এলাহাবাদ যাবার তাগিদ ও আকর্ষণ দুটোই কমে গেল। তাছাড়া দাদা বৌদির সংসারে আমার আসনটা ঠিক মজবুত ছিল না। আমার কাছে এলাহাবাদের একমাত্র আকর্ষণ ছিল আমার ছোট্ট ভাইঝি ময়না। দীর্ঘ দুটি বছর ওকে না দেখে মনটা বড়ই উতলা হয়ে উঠেছিল। বড় ইচ্ছে করছিল ওকে আদর করতে। তাছাড়া ও যখন খুব ছোট্ট ছিল তখন থেকেই আমার কাছে রং-তুলি নিয়ে খেলা করত, গান শিখত। ইতিমধ্যে খবর পেলাম ময়না ভীষণ অসুস্থ। ফাইন্যাল পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, তার পরের দিনই বোম্বে মেলে চেপে পড়লাম। এলাম এলাহাবাদ।
মাস খানেক ধরে ময়নাকে নিয়ে জীবন-মৃত্যুর লড়াই চলল। তারপর ময়না ভাল হয়ে উঠল। ভেবেছিলাম বোম্বে ফিরে একটা চাকরি জোগাড় করব আর একটা ছোট্ট ষ্টুডিও খুলব। কিন্তু ময়না কিছুতেই ছাড়ল না। পৃথিবীতে শুধু ময়না ছাড়া আর কেউ আমাকে ভালবাসত না। তাই তাকে কাঁদিয়ে, তাকে প্রতারণা করে, তার ভালবাসার অপমান করে চোরের মতো পালিয়ে যেতে মন চায়নি। আমি বাধ্য হয়ে থেকে গেলাম এলাহাবাদে।
অলক থামেনি, আরো এগিয়ে গিয়েছিল। কিছু মাত্র দ্বিধা না করে, কার্পণ্য না করে তার চোখের জলের পূর্ণ ইতিহাস শুনিয়েছিল ডাক্তারকে।
…টেগোর সোসাইটি থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে অলককে গান গাইতে ধরল পাড়ার ছেলেরা। অনেক দিন চর্চা নেই বলে তাদের অনুরোধ এড়িয়ে গেল। শেষে অনুষ্ঠানের দিন অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পীর গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে টেগোর সোসাইটির সেক্রেটারী মাইক্রোফোনে ঘোষণা করলেন, আজকের অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী অলক মৈত্র।
নিরুপায় হয়ে অলককে গান গাইতে হয়েছিল। হারমোনিয়াম বাজাবার অভ্যাসটা ঠিক ছিল না। তাই বিশেষ অনুরোধে সেদিনের নির্ধারিত অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী কবিতা বাজিয়েছিল হারমোনিয়াম। প্রথমে ভেবেছিল একটি গান গাইবে, কিন্তু শ্রোতাদের দাবী ও কবিতার অনুরোধের মর্যাদা রাখবার জন্য অলককে চার চারটি গান গাইতে হয়েছিল। শ্রোতাদের নমস্কার করে স্টেজ থেকে উঠে উইং স্ক্রীনের পাশে এসেই অলক ধন্যবাদ জানিয়েছিল কবিতাকে। আপনাকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ। এই আনাড়ীর সঙ্গে বাজাতে আপনার নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হচ্ছিল, কিন্তু তবুও যে ধৈর্য ধরে বাজিয়েছেন তার জন্য আমি সত্যই কৃতজ্ঞ।