পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বেশ জ্বর হয়েছে। সারা দিন চুপচাপ শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। বিকেলে কফি খেতেও বেরুলাম না। সন্ধ্যার পর ছাদে গিয়ে একটা ইজিচেয়ারে বসে চাঁদের আলোয় দূরের হরিপর্বত দেখছিলাম। ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি। কার যেন একটা ঠাণ্ডা হাত কপালে লাগতেই চমকে উঠলাম। চেয়ে দেখি রত্না।
কি ব্যাপার? তুমি?
রত্না আমার সে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল, জ্বর হয়েছে একটা খবর তো দিতে পারতেন।
একটু মুচকি হেসে রত্নার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলাম। বললাম, তারিককে একটু ডাক দাও না, কফি খেতাম।
তারিককে একটু আমাদের বোটে পাঠিয়েছি, এখুনি আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রত্নার বাবা-মা এসে হাজির। মহা ব্যস্ত হয়ে চ্যাটার্জী সাহেব আমার নাড়ী পরীক্ষা করলেন, জিভ দেখলেন, কপালে বুকে হাত দিলেন। তারপর তার ছোট্ট এ্যাটাচি থেকে কি যেন একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বের করে আমাকে খাইয়ে দিলেন।
পরের দুটি দিন মিস্টার ও মিসেস চ্যাটার্জী এসেছিলেন আমাকে দেখতে। রত্নাও এসেছিল, তবে হিসেব করে নয়। সকালে এসেছে, দুপুরে এসেছে, এসেছে সন্ধ্যায় ও রাত্তিরে। আমার তদারক করেছে, আমার সঙ্গে গল্প করেছে। দুটি দিন পরেই আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম, কিন্তু তবুও রত্না আসত, আসত গল্প করতে, গল্প শুনতে।
কয়েকদিন পর লক্ষ্য করলাম, রত্না কি যেন আমাকে বলতে চায় অথচ বলে না বা বলতে পারে না। একটি একটি করে দিন চলে যায়, আমার শ্রীনগরত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় মিস্টার ও মিসেস চ্যাটার্জী রত্নাকে নিয়ে এলেন আমার হাউস বোটে। অনেক গল্পগুজব হলো। শেষে ওরা বিদায় নিলেন।
রত্না বলল, মা তোমরা যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।
রত্না আর দেরী করেনি। সেদিন রাত্রে আমার হাউস বোটের ছাদে বসে আবছা চাঁদের আলোয় রত্না তার জীবননাট্যের নাতিদীর্ঘ অথচ ঘটনাবহুল কাহিনী শুনিয়েছিল আমাকে। নির্বাক, নিশ্চল, মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে কাহিনী শুনেছিলাম আমি।
০২.
প্রথম মাস দুই সারা লণ্ডন শহরটাকে চষে ফেলল কিন্তু তবুও কোন সুরাহা করতে পারল না অলক। পরে একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে পরিচয় হয় এক ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে এবং শেষে তাঁরই সাহায্যে ফুট স্ট্রীটের এক আধাখ্যাত সাপ্তাহিকের আর্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি পায়। অলকের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ডিরেক্টরের সুপারিশে ছমাসের মধ্যে অলকের মাইনে বারো থেকে পনেরো পাউণ্ড হলো।
মাইনে বাড়ার পর অলক বাসা পাল্টাল। গোল্ডর্স গ্রীনে একটা ছোট্ট দুখানা ঘরের ফ্ল্যাট নিলো। একখানা ঘরে ষ্টুডিও হলো। বেডরুমের কোন এক কোণায় রান্নার ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু নিজের বাড়ীতে একটু আধটু চা-কফি ছাড়া আর কিছু অলক করতে পারত না। নতুন নতুন যারা দেশ থেকে যায় তারা অবশ্য এর চাইতে বেশী কিছু পারে না। দুচার মাসের মধ্যে সবাইকে রান্না-বান্না শিখে নিতে হয়। অলক সে তাগিদটুকুও বোধ করত না। সকাল বেলায় দুএক কাপ চা খেয়ে অফিস বেরুবার পথে গোল্ডর্স গ্রীন স্টেশনের পাশে একটা ইটালীয়ান রেস্তোরাঁয় হেভী ব্রেকফার্স্ট খেয়ে নিত। দুপুরে লাঞ্চের টাইমে ফ্লীট স্ট্রীটের কোন না কোন রেস্টুরেন্টে দুএকটা স্যাণ্ডউইচ আর এক কাপ কফি খেতো।
বিকেলে অফিস ছুটির পর প্রায়ই চারিং ক্রশ অবধি হেঁটে আসত। কোনদিন ষ্ট্ৰাণ্ড, কোনদিন ভিক্টোরিয়া এম্বব্যাঙ্কমেন্ট ধরে হেঁটে আসতে আসতে অলকের বেশ লাগত মানুষের ভীড় দেখতে। স্ট্র্যাণ্ডের উইণ্ডো শপিংও মন্দ লাগত না। কিছুকাল পরে যখন এসব পুরনো হয়ে গেল তখন সোজা চলে আসত নিজের ফ্ল্যাটে। নিজের স্টুডিওতে কাজ করত অনেক রাত অবধি।
ল্যাণ্ডস্কেপের চাইতে জীবন্ত মানুষের পোর্ট্রেট আঁকতেই অলকের বেশী ভাল লাগত। প্রথম দিন ইজেলের সামনে রং তুলি নিয়ে বসবার সময় ভেবেছিল সামনের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পোর্ট্রেট আঁকবে। কিন্তু তাই কি হয়? যার স্মৃতি, যার ভালোবাসা অলকের জীবন যাত্রার একমাত্র পাথেয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই কবিতারই পোর্ট্রেট আঁকল অলক। একটির পর একটি করে চার রকমের চারটি পোট্রেট আঁকল কবিতার। স্টুডিওর চার দেওয়ালে ঝুলনো হলো সেই চারটি পোর্ট্রেট। রিভলবিং একটা টুলের পর বসে অলক ঘুরে ঘুরে দেখত সে পোর্ট্রেটগুলো আর মনে মনে বলতো কবিতা, তুমি আমার কাছে নেই, পাশে নেই সত্য কিন্তু আমার জীবনের চতুর্দিকে থেকে তুমি আমার সমস্ত সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছ। এই বিদেশ বিভূঁইতে শুধু তুমিই আমাকে চতুর্দিক থেকে রক্ষা করবে।
বেডরুমে একলা একলা ঘুমুতে মন টিকত না। প্রায়ই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেত। ছুটে আসত স্টুডিওতে। বাকি রাতটুকু কবিতার চারটি পোর্ট্রেট দেখে কাটাত অলক।
তারপর মাস কয়েকের অক্লান্ত পরিশ্রমে কবিতার একটা লাইফ সাইজ পোর্ট্রেট তৈরী করল অলক। জীবনের এত দরদ দিয়ে, এত ভালবাসা দিয়ে মনের সমস্ত সত্ত্বা, সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে পর পর কটি রাত জেগে পোর্ট্রেটের ফিনিশিং টাচ দিয়েছিল অলক। যে কবিতাকে নিজের জীবনে, নিজের সংসারে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তাকেই রং-তুলি নিয়ে বরণ করে তুলল শিল্পী অলক, প্রেমিক অলক। এই নতুন পোর্ট্রেটকে দেবীর মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করল নিজের বেড রুমে।