লীনা শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।
সেকি! অতবড় একটা ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে আলাপ হলো অথচ তার ঠিকানাটা রাখলে না?
লীনা শুধু বলল, ভুলে গেছি।
৭. ছোট ছোট মেঘের টুকরো
০১.
ছোট ছোট মেঘের টুকরোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে চাঁদ আবার লুকিয়ে পড়ল। রত্না একটু আড়াল দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। আমার সান্ত্বনা জানাবার কোন ভাষা ছিল না। তাছাড়া গলা দিয়ে যেন কথাও বেরুতে চাইল না। ইচ্ছা করছিল রত্নার চোখের জল মুছিয়ে দিই, তাকে অনেক কিছু বলে একটু সান্ত্বনা জানাই। কিছুই পারলাম না। দুজনেই চুপচাপ বসে রইলাম।
কতক্ষণ যে দুজনে এমনি করে নিশ্চল দুটি প্রাণহীন পাথরের মূর্তির মতো বসেছিলাম, তা মনে নেই। মনে আছে, রত্নার মা রত্নাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের হাউস বোটে।
আমার হাউস বোটের ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে শিকারায় চড়বার সময় শাড়ীর আঁচলটা একটু টেনে ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে রত্না শুধু বলেছিল, চলি দাদা, কাল সকালে আবার আসব।
আমি তারও কোন জবাব দিতে পারিনি। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম বলেও মনে হয় না।……
…অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর গিয়েছিলাম। বহুদিন পরে, বহু চেষ্টা করে কদিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিলাম সাংবাদিক জীবনের নিত্যকর্ম পদ্ধতি থেকে। ভেবেছিলাম, ডাল হ্রদের জলে হাউস বোটে ভাসতে ভাসতে একটু তাজা করে নেব নিজের দেহ আর মনকে। বায়ুগ্রস্থ আমেরিকান টুরিষ্টদের মতো উল্কার বেগে ঘুরে বেড়াবার কোন পরিকল্পনা আমার ছিল না। গুলমার্গ পহলগাও দেখারও কোন আগ্রহ ছিল না। অন্যান্য বাঙ্গালী টুরিষ্টদের মতো বক্স-ক্যামেরা হাতে নিয়ে শালিমার গার্ডেন দেখতেও আমি চাইনি। তাইতো তারিক-এর নিউ মডার্ণ প্যারিস হাউস বোটে এসেই বলেছিলাম, দুটো টাকা বেশী নিও কিন্তু নতুন খদ্দের এনে আর ভীড় বাড়িও না। আর একটা বিষয়ে তারিককে সতর্ক করেছিলাম, খবরদার! খবরের কাগজ আনবে না, আমি চাইলেও আনবে না। তাইতো তিন দিন ধরে নিউ মর্ডাৰ্ণ প্যারিসে কাটাবার পর এক কাপ কফি খেতে গিয়েছিলাম নেহেরু পার্কের রেস্টুরেন্টে।
তিন দিন পর কিছু মানুষ দেখে বোধহয় একটু ভালই লেগেছিল। পরের দিন বিকালেও গেলাম। সেদিনও বেশ লাগল। তারপর থেকে বিকালের দিকে এক কাপ কফি খাবার অছিলায় কিছু নতুন মানুষ দেখার লোভে রোজই যেতাম নেহেরু পার্কের ঐ রেস্টুরেন্টে।
সেদিনও একই উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম। কফি খাওয়াও হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। ঠিক উঠব উঠব ভাবছি এমন সময় কোথা থেকে ছুটে এসে রত্না বলল, বাচ্চুদা আপনি এখানে?
আমাকে দেখে রত্না যতটা অবাক হয়েছিল, আমিও ওকে দেখে ঠিক ততটাই বিস্মিত হয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কোথা থেকে?
মাত্র ঐ কটি মুহূর্তের মধ্যেই রত্নার সব চাঞ্চল্য, সব উচ্ছ্বাস বিদায় নিল। সারা মুখের চেহারাটাই যেন বদলে গেল। কেমন যেন হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে গেল রত্না। সেদিন বিশেষ কিছু বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকু বুঝেছিলাম রত্না পাল্টে গেছে। কেন সে নিষ্প্রভ হয়েছিল সেদিন, কেন তার সব উচ্ছ্বাস বিদায় নিয়েছিল মাত্র একটি মুহূর্তের মধ্যে, সেসব কিছুই বুঝতে পারিনি।
রত্না শুধু বলেছিল, মাসখানেক হলো আমি লণ্ডনের সংসার তুলে চলে এসেছি। একটু থেমে বলেছিল, মন মেজাজ বিশেষ ভাল না; তাই বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে এসেছি।
আমি আর উঠলাম না। রত্নাকে বললাম, বসো কফি খাবে তো?
মুখে কোন উত্তর দিল না। জিভ দিয়ে নীচের ঠোঁটটা একটু কামড়াতে কামড়াতে শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল আমার প্রস্তাবে।
কফি খেতে খেতে আমি বললাম, কি আশ্চর্য এই দুনিয়াটা! কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি শ্রীনগরে তোমার দেখা পাব।
ঠিক বলেছ বাচ্চুদা, দুনিয়াটা বড় আশ্চর্যের জায়গা। মানুষ যা চায়, যা ভাবে তা হয় না। আর যা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়, ঠিক সেটাই জীবনে ঘটবে। কফির কাপ থেকে মুখটা উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না বাচ্চু দা?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, ঠিক বলেছ।
কফি খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে নেহেরু পার্কে একটু ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে জিজ্ঞাসা করলাম, লণ্ডন থেকে কবে দেশে ফিরলে?
রত্না যেন কেমন আনমনা ছিল। মনে হলো আমার কথা শুনতে পায়নি। আবার প্রশ্ন করলাম, কবে দেশে এলে?
এইতো কিছুদিন হলো; এখনও একমাস হয়নি।
বিনয় ডাক্তার কেমন আছে?
কি বললেন?
বিনয় ডাক্তার কেমন আছে?
ও! একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল রত্না। বলল, খুব ভালো।
আরো কয়েক মিনিট ঘুরে বেড়ালাম পার্কের মধ্যে। এতদিন পর এমন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার সঙ্গে দেখা হলো, কিন্তু তবুও কথাবার্তা বলার বিশেষ তাগিদ না দেখে মনে হলো, রত্নার মনমেজাজ বোধ হয় ভাল নেই।
রত্নাকে পৌঁছে দিলাম ওদের হাউস বোটে, দি প্যারাডাইসে। আমাকে দেখে ওর বাবা-মা খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। পরে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিন বিদায় নিয়ে চলে এলাম আমার হাউস বোটে।
মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে গিয়েছিল, মাথাটাও কেমন যেন ঝিম ঝিম করছিল। হাত-পা ছড়িয়ে ড্রইং রুমে সোফার পর শুয়ে পড়লাম। তারিক একটু উতলা হয়ে আমার তবিয়তের খবর নিল। আমি ওকে নিশ্চিন্ত হতে বলে একটু চোখ বুজলাম। ডিনার খাবার জন্য তারিক ডেকেছিল কিন্তু আমি আর উঠিনি।