হঠাৎ এয়ার-হোস্টেস এসে ব্রেকফার্স্ট দিয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল, স্যার, ইউ উইল হ্যাভ কফি অর টি?
কফি।
হোয়াট অ্যাবাউট ইওর ওয়াইফ, স্যার?
এয়ার-হোস্টেসের কথা শুনে চমকে উঠলাম। কে যেন আমার কণ্ঠস্বর রোধ করে ধরল, আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না।
একটি মুহূর্ত নষ্ট না করে লীনা উত্তর দিল, ক্যান আই ডিফার ফ্রম মাই হাসব্যাণ্ড?
একগাল হাসি হেসে এয়ার-হোস্টেসটি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।
বিদায় নেবার আগে এয়ার হোস্টেস এ-কথাও জানিয়ে গেল, আপনাদের ছেলের ঘুম ভাঙ্গলে আমাকে জানাবেন, আমি তার খাবার দিয়ে যাব।
এবারেও লীনা উত্তর দিল, থ্যাঙ্ক ইউ।
এবার আমার কণ্ঠস্বর ফিরে এলো। লীনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ কি করলে?
নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, কি আর করলাম? আমাকে-তোমাকে স্বপনকে পাশাপাশি দেখে এয়ার-হোস্টেসের পক্ষে কি অন্য কিছু ভাবা সম্ভব?
ভেবে দেখলাম সত্যিই তো। তবুও জিজ্ঞাসা করলাম, তা তো বুঝলাম, কিন্তু তুমি তো সত্যি কথা বলতে পারতে?
আমি কেন তর্ক করব বল? দুনিয়াতে যে স্বীকৃতি আমাকে কেউ দেয়নি, সেই স্বীকৃতি আজ এই অপরিচিতা এয়ারহোস্টেসের কাছ থেকে পেলাম। আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, জীবনে কোনদিন ভুলব না এই এয়ার-হোস্টেসকে।
একটু থামল। আমার চিবুক ধরে আমার মুখটাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে লীনা প্রশ্ন করল, এয়ার-হোস্টেসের কথা তোমার ভাল লাগেনি? পারবে তুমি ওর এই কথা ভুলতে?
এমনি মিষ্টি আমেজ নিয়ে ভাসতে ভাসতে প্যান-আমেরিকানের পক্ষীরাজ এলো রোম, এলো জেনিভা। এলো লণ্ডন।
প্লেন থেকে বেরুবার আগে লীনাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমাকে অপ্রত্যাশিত মর্যাদা অভাবনীয় স্বীকৃতি দেবার জন্য। উপদেশ দিলাম, সুখে থেকো, সাবধানে থেকো। আশ্বাস দিলাম, স্বামী পুত্র বা তোমার যে-কোন প্রয়োজনে যদি কোনদিন স্মরণ কর, তবে বুঝব আমার কৌমার্যের এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছি।
স্বপনকে কোলে টেনে নিয়ে অনেক আদর করলাম। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আশীর্বাদ করলাম।
এক ফাঁকে হঠাৎ লীনা আমাকে প্রণাম করতে চমকে উঠলাম। আমি হাত তুলে আশীর্বাদ করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। লীনার চোখের জলটা পর্যন্ত মুছিয়ে দিতে পারলাম না। আমার চোখের দৃষ্টিটাও ঝাপসা হয়ে উঠল।
লীনার কেবিন ব্যাগ ও আরো দুটো-তিনটে ছোটখাট জিনিসপত্র এক হাতে ও অন্য হাতে আমার ফেলট ওভারকোট ও ব্রীফ-কেস তুলে নিলাম। আমার পিছন পিছন স্বপনের হাত ধরে লীনা নেমে এলো।
তিন নম্বর ওসানিক বিল্ডিংয়ে হেলথ কাউন্টারের দিকে এগোতেই লীনার স্বামী কাঁচে-ঘেরা উপরের ভিজিটার্স গ্যালারি থেকে হাত নাড়লেন। স্বপন চিৎকার করে ঘোষণা করল, ঐ যে আমার বাবা। স্বামীর দিকে তাকিয়ে লীনা শুধু একটু শুকনো হাসি হাসল।
আমি ওদের নিয়ে হেলথ কাউন্টার থেকে পাশপোর্ট কাউন্টার হয়ে কাস্টমস কাউন্টারে এলাম। আমাদের লণ্ডন হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী আমার বন্ধু মিঃ চারী আগে থেকেই কাস্টমস কাউন্টারে অপেক্ষা করছিলেন। হাই কমিশনের আরো দুজন স্টাফ এসেছিলেন আমার জন্য। তাঁরা আমার মালপত্র নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। আমার অনুরোধে লীনাদের মালপত্রও তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই দেখে নিলেন কাস্টমস-এর একজন অফিসার। অফিসারটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা সবাই বাইরে এলাম।
বাইরের ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য আমি ওভারকোট পরে মাথায় ফেলট চাপিয়ে নিলাম। স্বপন ছুটে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরল। খুব নরম গলায় লীনা পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি হচ্ছেন মিঃ তাপস সেন। করাচী ইণ্ডিয়ান হাই কমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারী এবং এখন চলেছেন ইউনাইটেড নেশনস এ। একটু থেমে বলল, প্লেনে পরিচয় হলো তোমার ছেলের দৌলতে। শুধু তাই নয়, তোমার ছেলের অনেক দৌরাত্ম্য সহ্য করেছেন, অনেক খামখেয়াল চরিতার্থ করেছেন এবং সর্বোপরি পথ দেখিয়ে মালপত্র টেনে এনে অশেষ উপকার করেছেন।
এরপর স্বামীর দিকে ফিরে শুধু বলল, ইনি আমার স্বামী মিঃ সরকার।
আমি হাতজোড় করে মিঃ সরকারকে নমস্কার করলাম। বললাম, আপনার স্ত্রী যে এত মিথ্যা কথা বলতে পারেন, তাতো ভাবিনি। আমার সম্পর্কে যে বক্তৃতা দিলেন তা একটুও সত্যি নয়। একটু ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বললাম, দুনিয়াতে আমি বড় একা, বড় নিঃসঙ্গ। তাই স্বপন ও আপনার স্ত্রীর অশেষ কৃপায় কিছু সময়ের জন্য অন্তত নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। সেজন্য আমি ওঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
স্বপনকে আর একটি বারের জন্য কোলে তুলে নিয়ে আদর করলাম। বললাম, কই, তুমি তো তোমার মার গান শোনালে না?
স্বপন বলল, মা, গাও না একটা গান।
আমরা সবাই না হেসে পারলাম না। মিঃ সরকারকে বললাম, বেশ ছেলেটি আপনার। ইচ্ছা করে চুরি করে পালাই।
মিঃ সরকার একটু হাসলেন।
আমি আর একবার মিঃ সরকারকে নমস্কার করলাম, স্বপনকে আদর করলাম এবং সব শেষে লীনাকে বললাম, আপনাকে ও আপনার ছেলেকে হয়তো অনেকদিন মনে রাখব, ক্ষমা করবেন।
আমি আর কালবিলম্ব না করে বিদায় নিয়ে মিঃ চারীর সঙ্গে জনাকীর্ণ লণ্ডনের রাজপথে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।…
তাপস বিদায় নেবার পরও কয়েকটা মুহূর্ত লীনা নিশ্চয় পাথরের মতো তারই পথের দিকে চেয়েছিল।
মিঃ সরকার বললেন, তুমি ওঁর পুরো ঠিকানাটা রেখেছ?