দু-এক মিনিট নীরবতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। হঠাৎ স্বপন আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি আমার মা-র গান শুনেছ?
এবার আমিও হেসে ফেললাম। স্বপনের গাল টিপে একটু আদর করে বললাম, বল না তোমার মাকে একটা গান শোনাতে।
দুহাত দিয়ে স্বপন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, একটা গানকর না মা।
না বাবা, এখানে গান করে না, লীনা উত্তর দেয়।
আর সব প্যাসেঞ্জাররা উপরে লাউঞ্জে অথবা ডিউটি-ফ্রি শপে চলে গিয়েছিলেন। আমিও লীনা আর স্বপনকে নিয়ে উপরে গেলাম। লেবাননের মরুপ্রান্তরের উষ্ণ হাওয়ার বেইরুট এয়ারপোর্টের টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে প্রবেশের অনুমতি নেই। সেখানে কৃত্রিম ঠাণ্ডা হাওয়ার রাজত্ব; কিন্তু তবুও লীনার সান্নিধ্যে বিচিত্র অনুভূতিতে আমার গলা বুক শুকিয়ে এলো। একটা চাপা উত্তেজনায় শরীরটা কেমন করে উঠল। আয় আয় চাঁদ আয় মুখে বলা যায়, কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি চাঁদ এসে হাজির হয়, তাহলে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু ঘটতে পারে। সারা প্লেনে লীনাকে স্বপ্ন দেখেছি, তার কথা ভেবেছি, তার প্রতিটি স্মৃতি রোমন্থন করেছি। না-পাওয়ার বেদনার মধ্যেও একটু যেন সুখের, একটু যেন তৃপ্তির স্বাদ পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্নের লীনা, স্মৃতির লীনা, কাহিনীর লীনাকে আজ দীর্ঘদিন বাদে পাশে পেয়ে আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত চাঞ্চল্য দেখা দিল। বাইরে তার কোন প্রকাশ হতে দিলাম না, কিন্তু নিজে ভিতরে ভিতরে অসহ্য যন্ত্রণাভোগ করতে লাগলাম।
স্বপনকে চকোলেট কিনে দুবোতল কোল্ড ড্রিংক নিলাম, একটা বোতল লীনাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, এই নাও। আর কি খাবে?
কিছু না। তুমি কিছু খাবে?
না।
খাও না কিছু। আমি খাওয়াচ্ছি।
একটু চুপ করে উত্তর দিলাম, তুমি আদর করে, যত্ন করে, ভালবেসে খাওয়াবে, সে সৌভাগ্য করে তো-আমি জন্মাইনি। সেজন্য কয়েকটা মুহূর্তের জন্য সে আনন্দ, সে সৌভাগ্য, সে তৃপ্তিভোগ করে লাভ কি?
লীনা চুপ করে মাথাটা নীচু করল।
একটু পরে স্বপনের হাত ধরে ডিউটি-ফ্রি শপিং সেন্টারে ঢুকলাম। বাঁদিকে জুয়েলার্সের দোকানের সামনে এসে হঠাৎ লীনার হাতটা চেপে ধরে বললাম, একটা অনুরোধ রাখবে?
কি অনুরোধ?
আজ বুঝি কৈফিয়ৎ তলব না করে আমার অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়?
না, ঠিক তা নয় তবে…
তবে আবার কি?
দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে লীনা কি যেন মনে একটা ফন্দী আঁটল। বলল, দুটি শর্তে তোমার অনুরোধ রক্ষা করতে পারি।
শুনি কি শর্ত।
প্রথম কথা আমি যা দেব, তোমায় খেতে হবে, আর দ্বিতীয়তঃ প্লেনে আমাদের কাছে বসবে।
দুঃখের মধ্যেও একটু না হেসে পারলাম না। বললাম, তথাস্তু।
তারপর জুয়েলার্স সপে ঢুকে আঠারো পাউণ্ড দিয়ে বেশ একটা পছন্দসই সুইস ঘড়ি কিনে নিজে লীনার হাতে পরিয়ে দিলাম। লীনা কোন প্রতিবাদ, কোন মন্তব্য জানাল না, শুধু স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।
শপিং সেন্টার থেকে আবার স্ন্যাক বারে ফিরে লীনার শর্ত পূরণ করে একপেট খেলাম। দুজনে দুকাপ কফিও নিলাম।
একটু পরেই অ্যানাউন্সমেন্ট হলো রোম, জেনিভা, লণ্ডন, নিউইয়র্কগামী প্যান-আমেরিকানের যাত্রীদের উদ্দেশ্যে। যাত্রারম্ভের জন্য প্লেন প্রস্তুত। আমরা নীচে গেলাম। দুদরজা দিয়ে দুদিক দিয়ে প্লেনে চড়লাম। চীফ স্টুয়ার্টকে ডাক দিয়ে অনুরোধ করলাম, আমার এক আত্মীয়া মিসেস সরকার ও মাস্টার সরকার টুরিস্ট ক্লাসে আছেন। আমি কি তাদের পাশে বসতে পারি?
প্যাসেঞ্জার-চার্টটা দেখে চীফ স্টুয়ার্ট উত্তর দিল, উইথ প্লেজার সার।
ফার্স্ট ক্লাস কেবিন থেকে বেরিয়ে আমি লীনাদের পাশে বসলাম। সীটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে লীনা টিপ্পনী কাটল, আমি ভাবলাম ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে ঢোকার পর হয়তো আমাকে ভুলে গেলে।
ভুলতে পারলে হয়তো ভালই হতো। যদি নিজের সমস্ত অতীত স্মৃতি মুছে ফেলে সাধারণ ডিপ্লোম্যাটদের মতো হুইস্কির গেলাসে ডুব দিয়ে সর্বদেশের যুবতীদের উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারতাম, তবে হয়তো বুকের ভেতরটা এমন জ্বলে-পুড়ে ছারখার হতো না।
পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্যের তাড়া খেয়ে রাত্রির বুক চিরে প্লেনটা ছুটে চলেছিল রোমের দিকে। অফুরন্ত রাত্রির অন্ধকারের আমেজে যাত্রীরা কম্বল জড়িয়ে তখনও ঘুমোচ্ছেন। অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর অনেকক্ষণ বসে বসে কাটাবার পর স্বপনও ঘুমিয়ে পড়ল। তিনটি সীটের মাঝের দুটি হাত তুলে দেওয়া হলো। জানালার দিকের সীটে স্বপনকে শুইয়ে লীনা আমার পাশ ঘেসে বসল। আমি বললাম, এত কাছে, এত নিবিড় হয়ে কেন?
লীনা একটিবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জীবনে তো তোমাকে পেলাম না। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য একটু কাছে বসছি, তাতেও তোমার আপত্তি? একটু থেমে বলল, জীবনে তো অনেক ইচ্ছাই পূর্ণ হলো না। ভগবান যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে তোমাকে এই রাত্রিটুকুর জন্য পাইয়ে দিয়েছেন, তখন এই আনন্দ থেকে, এই সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। লীনা আস্তে আমার কাঁধের ওপর মাথা রেখে একটু কাত হলো।
বেশ লাগলো। হঠাৎ যেন মনে হলো আমি রাজা হয়েছি, মনে হলো, আমি যেন সব চাইতে সুখী লোক। মনে হলো, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাণীকে নিয়ে চলেছি দেশ-দেশান্তর দেখতে।
কখন যে লীনার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়েছি, তা নিজেও টের পাইনি। কিছুক্ষণ পর লীনা আমার আর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলে উপলব্ধি করলাম, দুটি হাতে দুটি প্রাণ আজ কত নিশ্চিন্তে, কত নির্ভয়ে, কত সহজে নির্ভরশীল।