আরো মনে পড়ে। মনে পড়ে শেষ অধ্যায়ের কথা। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
মাসিমার প্রস্তাব শুনে লীনার বাবা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বললেন, একটা অর্ডিনারী বি-এ পাস করা ছেলের সঙ্গে কি এই মেয়ের বিয়ে হতে পারে?
লীনার দাদা বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিপ্পনী কেটেছিল, বলিহারি ছেলে রে বাবা! বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে প্রেম করে বিয়ে করতে চায়।
মাসিমা অনেক বুঝিয়েছিলেন, তাপস সাধারণ ছেলে নয়, সে একদিন দশ জনের একজন হবেই।
শুধু শূন্যহাতে নয়, অজস্র, অপমানের বোঝা নিয়ে মাসিমা ফিরে এসেছিলেন।
লীনা কেঁদেছিল, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছিল, কিন্তু নিজের মনের কথা, প্রাণের ইচ্ছা জানাতে পারেনি লজ্জায়, সঙ্কোচে। সংস্কার তার কণ্ঠরোধ করেছিল। আরো অসংখ্য প্রেমের কাহিনীর মতো এদের কাহিনীও এইখানেই শেষ হলো।
যৌবনে সব বাঙালী মেয়েই প্রেমে পড়ে। যে বাঙালী মেয়ে বলে যৌবনে সে প্রেমে পড়েনি, সে হয় মিথ্যাবাদিনী, নয় তো মানসিক বিকারগ্রস্ত। দেহের মধ্যে নতুন জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে মনের রাজ্যে নতুন পলিমাটি পড়ে সে উর্বর হয়, ফুল ফোটে, ফসল ধরে। প্রেমের ফসল। ছোটবেলায় মেয়েরা পুতুল খেলা করে। বর সাজায়, বৌ সাজায়। তাদের বিয়ে দেয়, নেমন্তন্ন খাওয়ায়। পুতুলকে ছেলে সাজায়, আদর করে, কোলে নিয়ে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ায়। আবার ঝিনুকবাটি নিয়ে দুধ খাওয়ায়, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করে, ওষুধ খাওয়ায়। খেলতে খেলতেই মেয়েরা হঠাৎ একদিন বড় হয়, তাদের অঙ্গে অঙ্গে যৌবন দেখা দেয়, দেহের নেশায় মাতাল হয়। পুতুল খেলা আর ভাল লাগে না। এবার মানুষ নিয়ে খেলা শুরু হয়। মেয়েরা খেলতে খেলতে শেখে, শেখে আগামী দিনগুলির জীবনধারার সঙ্গে নিজেদের মিশেয়ে দিতে।
লীনা পুতুল খেলার মতো তাপসের সঙ্গে খেলা করেনি। আত্মসমর্পণ করেছিল সে। তাপসের ভালবাসার ঐশ্বর্যে সে মন ভরিয়ে তুলেছিল, কিন্তু আর এগুতে পারেনি। নিজে মর্মে মর্মে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছে, কিন্তু একটি বারের জন্যও মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারেনি তার জীবনের চরম কাহিনী। মনে হয়েছে, একটি একটি করে বুকের পাঁজরাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে, তবুও পারেনি বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে, দাদার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।
তাপস আবার একদিন পাটনা ফিরে এম-এ পড়তে শুরু করল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পক্ষীক্ষা দিয়ে ফরেন সার্ভিসে ঢুকল। একদিনের জন্য কলকাতা এসে মাসিমাকে প্রণাম করে চলে গেল জেনেভা। জীবনে আর পিছনে তাকায়নি। তাপস কলকাতা ছাড়ার পরই লীনার বিয়ে হয়েছিল, মাসিমা নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাপস সেখবর পেয়েছিল। বিয়ের পরও মাসিমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত লীনা। কলকাতায় এলে দেখা করত। তাপস তাও জানত।
…আজ হঠাৎ এই প্লেনের মধ্যে ঐ ছোট্ট স্বপনকে দেখে মনে পড়ল সমস্ত স্মৃতি। ইচ্ছা করল একটি বারের জন্য স্বপনকে ডেকে এনে আদর করি। কিন্তু প্লেনের সবাই এখন ঘুমে কাতর। টুরিস্ট ক্লাসে উঁকি দিয়ে দেখলাম দুজন জাপানী ভদ্রলোক রিডিং-লাইট জ্বেলে বই পড়ছেন, আর সবাই ঘুমিয়ে আছেন। ভারতীয় যাত্রীদের কাছে এখন শেষরাত্তির হলেও, জাপানীদের ঘড়িতে এখন দুপুর। করাচী ছাড়ার পরই তারা ব্রেকফার্স্ট খেয়েছেন, বেইরুটের পরই লাঞ্চ খাবেন।
নিজের সীটে বসে আর-একবার বাইরের আকাশটা দেখে নিলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। দু-তিন মিনিট বাদেই সারা প্লেনে আলো জ্বলে উঠল। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিলাম। বুঝলাম বেইরুট এসে গেছি। ক’মিনিট বাদে এয়ার-হোস্টেস জানাল, আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা বেইরুটে পৌঁছব। যাত্রীরা যেন ধুমপান বন্ধ করে সীট-বেল্ট বেঁধে নেন। এয়ারহোস্টেস আরো জানাল যে, বেইরুট থেকে নতুন বৈমানিক ও কর্মীরা বিমানের ভার নেবেন।
প্লেন বেইরুটে পৌঁছল। আমরা তিনজন প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জার সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা বাসে উঠে টার্মিনাল বিল্ডিং গেলাম। টুরিস্ট ক্লাসের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মেয়ে-পুরুষ যাত্রী আর একটা বাসে দু-এক মিনিট বাদেই টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে এলেন। সবে একটা সিগারেট ধরিয়ে এলিভেটরের দিকে দু-পা বাড়িয়েছি, এমন সময় ছুটে এসে স্বপন আমার হাতটা ধরে বললে, আমি স্বপন।
টুক করে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে আমি বললাম, তুমি বুঝি স্বপন?
গাল দুটো ফুলিয়ে চোখ দুটো টেনে টেনে বললো, আমিই তো স্বপন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, স্বপন, তোমার বাবা-মা কোথায়?
আমার বাবা তো লণ্ডনে, তুমি জানোনা?
না তো।
তুমি আমার মাকে দেখেছ?
না তো।
স্বপন প্রায় হুড়মুড় করে আমার কোল থেকে নেমে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলল, এস না আমার মাকে দেখবে।
স্বপন আমার বাধা মানল না, টানতে টানতে হাজির করল তার মার কাছে। স্বপন বলল, এই তো আমার মা।
আমি তো প্রায় পাথরের মতো হয়ে কোন মতে উত্তর দিলাম, তাই বুঝি?
লীনা বলল, তুমি!
হ্যাঁ, আমি।
কেমন আছ?
খুব ভাল।
একটু থেমে পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি, তুমি কেমন আছ?
আমিও খুব ভাল আছি।
বেশ তো।
দুজনেই দুজনকে একবার প্রাণ ভরে দেখে নিলাম।
তোমার শরীর তো খারাপ হয়ে গেছে, আমি বললাম।
না, না, শরীর ঠিকই আছে। তোমার দেখার ভুল।
তাই নাকি?
লীনা হেসে মাথা নীচু করল।