ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফোঁটাবার চেষ্টা করে বৌদি বললেন, না, না, ঠাকুরপো কাঁদছি কোথায়?
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কোরো না বৌদি। আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে গেল। তারপর বললাম, এতদূর থেকে ছুটে আসি তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করে আনন্দ পাবার জন্যে, তোমাকে কাঁদাবার জন্যে নয়।
চোখের জল বন্ধ হলো, কিন্তু চোখের মণিদুটো স্থির করে এমন উদাস দৃষ্টিতে বৌদি চাইলেন যে, আমার বুকের মধ্যে জ্বালা করে উঠল। নীচের ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে খুব ধীর স্থির আস্তে বৌদি বললেন, ঠাকুরপো, তুমিও যেমন আমাকে পেয়ে আনন্দ পাও, আমিও তেমনি তোমাকে কাছে পেয়ে অনেক শান্তি পাই। আজ তুমি ছাড়া আমার ঘর আলো করার আর কে আছে বলতে পার?
ঠিক বলেছ বৌদি। তোমার ঘরে, তোমার মনে, তোমার জীবনে আর কোনদিন সূর্যের আলো পড়বে না বলে তুমি আমার মতো একটা মাটির প্রদীপকে ধন্যবাদ জানাচ্ছ?
তুমি মাটির প্রদীপ হলেও আমার এই জমাট বাঁধা অন্ধকার জীবনে তার অনেক প্রয়োজন, অনেক দাম। তাই না ঠাকুরপো?
আর বেশি কথা না বলে এয়ারপোর্ট থেকে বৌদির বাসায় গিয়েছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ডান দিকের ঘরে ঢুকতেই টেবিলের ওপর নির্মলদার কলম, পেন্সিল, টাইপরাইটার, নোট বই, হাতঘড়ি আর একটা ছবি দেখতে পেলাম। বছর পাঁচেক আগে যেদিন সন্ধ্যায় এই বাড়িতে প্রথম পদার্পণ করি, সেদিনও ঠিক এমনি করেই সাজানো ছিল। ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্রও ঠিক এমনিই ছিল। আজকের সঙ্গে সেদিনের বিশেষ কোন পার্থক্যই ছিল না। তবে হ্যাঁ, সেদিন এই ঘরের মালিক নির্মলদা ছিলেন, আজ তিনি নেই। আর শুধু একটা পরিবর্তন নজরে পড়ল। সেদিন নির্মলদার ফটোটায় ফুল চন্দন ছিল না, আজ ছিল। পাঁচ বছর আগে যেদিন এসেছিলাম, সেদিন নির্মলাবৌদি নির্মলদাকে পূজা করতেন, আজ পূজা করেন তার ঐ ফটোটাকে। নির্মলদার টাইপরাইটার একটু খুললাম। ফটোটাকে হাতে তুলে নিলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই চোখের দৃষ্টিটা ঝাঁপসা হয়ে উঠল, তারপর ধীরে-ধীরে অজস্র ধারায় নেমে এল চোখের জল। আমাকে সান্ত্বনা জানাবার শক্তি বৌদির ছিল না। তিনিও আমারই মতন অতীত স্মৃতির ঝড়ে পথ হারিয়েছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বৌদি বললেন, ঠাকুরপো!
কি বৌদি?
পাঁচ বছর আগে প্রথম যেদিন এ বাড়িতে তুমি এসেছিলে সেদিনের কথা মনে পড়ে?
নির্মলদার স্মৃতিতে আমার মানসিক অবস্থা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না। মুখে কোন উত্তর দিতে পারিনি, শুধু মাথা নেড়ে জানিয়েছিলাম, হ্যাঁ, মনে পড়ে। বৌদির পাশে দাঁড়িয়ে নির্মলদার ফটোটার মুখো মুখি হয়ে শুধু পাঁচ বছর আগের কথাই নয়, আরো অনেক কথা, অনেক স্মৃতি আমার মনে সেদিন ভীড় করে এসেছিল।
আমি ঠিক নির্মলদার সহকর্মী না হলেও আমাদের মধ্যে বেশ একটা হৃদ্যতা, ভ্রাতৃত্বের ভাব ছিল। বহু ট্যুরে আমরা দুজনে একসঙ্গে থেকেছি, বহু ঐতিহাসিক খবর দুজনে একসঙ্গে কভারও করেছি। দুজনের মধ্যে বেশ খানিকটা বয়সের পার্থক্য থাকায় খুব গভীরভাবে নির্মলদাকে কাছে টানতে পারিনি। আমি কলকাতা ছাড়ার পর শুনলাম নির্মলদা হঠাৎ অন্য একটা কাগজের ফরেন করেসপনডেন্ট হয়ে কায়রো গেছেন। বছর দুই পরে বেইরুটে এক বন্ধুগৃহে নির্মলদার সঙ্গে আমার দেখা। তারপর দুজনের দেখা হয় যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে। দুজনেই নন্ অ্যালাইনমেন্ট কনফারেন্স কভার করতে গিয়েছিলাম। একই হোটেলে প্রায় পাশাপাশি ঘরে ছিলাম আমরা দুজনে।
নির্মলদাকে নানাভাবে নানা জায়গায় দেখেছি। দেখেছি কাছ থেকে, দেখেছি দূর থেকে। বেশ লাগত নির্মলদাকে। ওর হাসি খুশিভরা মুখখানা আমাকে অনেক সময়েই অনুপ্রেরণা দিত। বহু বিষয়ে নির্মলদার আগ্রহ ছিল, কিন্তু কোনদিন কোন অবস্থাতেই মেয়েদের বিষয়ে তার কোন আগ্রহ দেখতে পাইনি। তাছাড়া নির্মলদার আর একটা বৈশিষ্ট্য আমার কাছে একবার নয়, দুবার নয়, বহুবার ধরা পড়েছিল। মাঝে মাঝেই উনি কোথায় যেন তলিয়ে যেতেন, অনেক চেষ্টা করেও ওঁকে খুঁজে পেতাম না। সন্দেহ হতো হয়তো কোন রহস্য আছে, কিন্তু চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি।
খবরের কাগজের রিপোর্টাররা বিভিন্ন কাগজে কাজ করলেও নিজেদের মধ্যে পারিবারিক হৃদ্যতার মতো মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুখে-দুঃখে পাশাপাশি না চললে আমাদের বেঁচে থাকাই মুশকিল। এই তো বিজয়দার বোন উমার বিয়েতে ওদের ব্যারাকপুরের বাড়িতে তমাল বা পূর্ণেন্দু যা করল, তা দেখে কি কেউ ভাবতে পারল ওরা ঐ পরিবারের কেউ নয়? কেউ কি জানতে পারল ওদের কাগজের মধ্যে দারুণ লড়াই? রিপোর্টারদের লেখার সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। এই তো মান্নার বাবা মারা গেলে বলাইদা যা করলেন বা অধীরদার মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে দেখা থেকে শুরু করে সবকিছুই তো রমেনদা করলেন, কিন্তু কেউ বুঝতে পারবে না, কেউ জানতে পারবে না ওঁরা সহকর্মী পর্যন্ত নন। রিপোর্টারদের মধ্যে এমন একটা অচ্ছেদ্য বন্ধন থাকা সত্ত্বেও কোন প্রবীণ রিপোর্টারকেও নির্মলদার বিয়ের জন্য অনুরোধ করতে দেখিনি। আমার বেশ একটু আশ্চর্য লাগত। নিজের মনে মনেই প্রশ্ন করতাম, কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেতাম না। দীর্ঘদিন পরে স্বয়ং নির্মলদার কাছ থেকেই এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম।