না, তারা চিন্তা করছেন না।
কেন?
ঠোঁটটা কামড়ে, চোখ দুটোকে একটু নীচু করে তাপস উত্তর দিল, তারা কেউই নেই।
লীনা হঠাৎ একটু চঞ্চল হয়ে, একটু উতলা হয়ে বলল, তাই নাকি?
লীনা পর পর অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিল। তাপস শুধু বলেছিল, তাপস সেনের জীবন কাহিনী বলার মতো নয়। শুধু জেনে রাখুন সে মাসিমার বাড়ি থাকে, স্কটিশ চার্চে বি-এ পড়ে। শেষে শুধু বলেছিল, আসুন না একদিন আমাদের বাড়ি, মাসিমা খুব খুশি হবেন।
হাসিমুখে লীনা বলেছিল, নিশ্চয়ই আসব।
দুদিন পরেই লীনা এসেছিল মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে। মাসিমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আলাপ হয়েছিল, অনেক গল্পও হয়েছিল কিন্তু তাপসকে দেখল না। অনেকক্ষণ বাদে লজ্জা সঙ্কোচ কাটিয়ে যতটা সম্ভব সহজ হয়ে লীনা একবার জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, তাপসবাবুকে দেখছি না তো মাসিমা!
না মা, সে তত এখন বাড়িতে থাকে না, ছাত্র পড়াতে গেছে। ঘাড় বেঁকিয়ে ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন, আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই আসবে।
তাপস ফিরে লীনাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। লীনা আর অপেক্ষা করেনি, হাত ঘড়ি দেখে বলল, অনেকক্ষণ এসেছি, এবার চলি।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল তাপস। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় লীনা বলেছিল, কাল সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাড়ি আসবেন।
কেন?
মা বলেছেন।
কেন?
ধন্যবাদ জানাবেন বলে।
কেন?
সেদিন অত কষ্ট করে আমাকে নির্বিঘ্নে বাড়ি আসবার ব্যবস্থা করার জন্য
সন্ধ্যাবেলায় তো আমাকে ছাত্র পড়াতে হয়।
একদিন না হয় ছাত্র নাই পড়ালেন।
তাপস গিয়েছিল, তবে একটু দেরী করে। চা খেয়ে একটু গল্প করে লীনার মাকে একটা প্রণাম করেই উঠে পড়েছিল।
শুধু লীনার নয়, তার মায়েরও বেশ লেগেছিল তাপসকে। কয়েক দিনের মধ্যে লীনার মনে একটা আশ্চর্য বিপ্লব ঘটে গেল। চৈত্রের খরার পর যেমন হঠাৎ কালবৈশাখী এসে সব কিছু ওলট-পালট করে দেয়, সবার অলক্ষ্যে লীনার জীবনেও এমনি ভাবে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। ভালবাসল তাপসকে।
পরবর্তী আড়াইটা বছর স্বপ্নের মতো কেটে গেল। দুটি মন, দুটি প্রাণ মিশে একাকার হয়ে গেল। দুটি জাবিন, দুটি সুর, দুটি ধারা একই ছন্দে, একই তালে, একই দিকে, একই উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল। জীবনের অর্থ বদলে গেল, বাঁচার আনন্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। দুটি স্বপ্নও মিশে এক হয়ে গেল। প্রত্যক্ষে মেলামেশা, অপ্রত্যক্ষে আত্মসমর্পণের পালা শেষ হলো।
আউটরাম ঘাটের ধার দিয়ে হেস্টিংসের দিকে এগোতে এগোতে লীনা প্রশ্ন করে, তোমার কি মনে হয় তোমার জীবনের সব অপূর্ণতা, সব প্রয়োজন, সব দাবি আমি মেটাতে পারব? পারব কি তোমাকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে সাহায্য করতে? তোমাকে সুখী করতে?
পায়ে চলা বন্ধ হয়, কিন্তু মন উড়ে চলে যায় অনাগত ভবিষ্যতের দিনগুলিতে।
তাপস বলে, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস থাকলে নিশ্চয়ই পারবে।
কেন, আমার নিষ্ঠা সম্পর্কে তোমার মনে কি আজও সন্দেহ আছে?
না, তা নেই। তবে মানুষের মন তো! ক বছর আগে যেমন তোমার এই নিষ্ঠা ছিল না, কবছর পরে হয়তো এই নিষ্ঠা কমতে পারে, বাড়তে পারে।
তাপস কোন বিষয়েই বেশী কিছু আশা করে না। তার আশা আকাক্ষা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সব বিষয়েই একটা সংযত ভাব আছে, তা লীনা ভাল ভাবেই জানে। তাই আর প্রশ্ন করে না।
মাসিমার মন-রাজ্যেও লীনার আধিপত্য বিস্তার হয়। কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যা নাগাত একটিবার সে আসবেই মাসিমার খোঁজ নিতে। বাথরুম থেকে বেরুলে মাসিমাকে সিঁদুর পরিয়ে দিতে লীনার বড় ভাল লাগে। মনে মনে মাসিমারও ইচ্ছা করে লীনার সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুরের একটা টান দিতে, কিন্তু সে আশার অভিব্যক্তি দেন না। সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে লীনা প্রণাম করে মাসিমাকে, মাসিমা বুকের মধ্যে টেনে নেন লীনাকে।
সেবার শীতকালে ঠাণ্ডা লেগে মাসিমা অসুস্থ হলে লীনা বিকালের দিকে রোজ রান্না করে গেছে। পরের দিন সকালের রান্না ফ্রিজে তুলে রেখেছে। মাসিমা আর ধৈর্য ধরতে পারেন না, কি বলব মা, তোমাকে কোনদিন বরণ করে ঘরে তুলতে পারব কি না জানি না, কিন্তু তার আগেই তুমি একে একে সব দায়িত্ব তুলে নিতে শুরু করলে!
লীনা কোন উত্তর দেয় না। হরলিকস আনার তাগিদে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।……
আজ করাচী থেকে বেইরুটের পথে তাপসের মনে পড়ে সে-সব দিনের স্মৃতি। সেসব দিনের পর মনের মধ্যে আরো অনেক দিনের স্মৃতি জমেছে, কিন্তু তবুও লীনার স্মৃতি অম্লান হয়ে রয়েছে তার মনে। মনে পড়ে জন্মদিনের কথা। খুব ভোরবেলায় লীনা এসে চুরি করে একটা প্রণাম করে পালিয়ে যেত। বিকালের দিকে সরকারীভাবে এসে কিছু উপহার দিত। আর? আর শোনাত গান।
মনে পড়ছে আরো অনেক দিনের কথা।
..জানো তাপস, আমার প্রথম ছেলে হলে তার কি নাম রাখব?
না।
স্বপন।
তাপস বলে, মেয়ে হলে?
ছবি।
এই দুটো নাম বুঝি তোমার খুব পছন্দ?
লীনা বলেছিল, আমার জীবনের স্বপ্ন সার্থক করে যে ছেলে হবে, সে হবে আমার স্বপন। আর যে মেয়ে আমাদের আগামী দিনের ছবি বাস্তব করে দেখা দেবে, তার নাম হবে ছবি i…
কাঁচের জানালা দিয়ে দূরের আকাশের মিটমিট করা তারাগুলো দেখতে দেখতে নিজের জীবন আকাশের ঐশ্বর্যে ভরা দিনগুলির স্মৃতি মিটমিট করে জ্বলে উঠল। জনক রোডের জীবনে ঐ তারা দূরে ছিল না। আর আজ? তারা দূরে বহুদূরে চলে গেছে। ঐ আকাশ, ঐ তারা হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়, কিন্তু হাতের নাগালের বাইরে।