আরও মাস ছয়েক বাদে একদিন দুজনে পাশাপাশি বসে কলেজ গিয়েছিল। তাপস ইচ্ছা করে লেডিস্ সীটে ওর পাশে বসেনি। পাশের সীটটা খালিই ছিল এবং কোন মহিলা যাত্রীও ছিলেন না।
ইশারায় আমন্ত্রণ পেয়েই তাপস পাশে বসেছিল। দুজনেরই মধ্যে প্রায় অজান্তে একটা সেতুবন্ধন রচনা হচ্ছিল। বাস-স্টপে এসে না দেখা হলে অদর্শনের অতৃপ্তি দুজনেই অনুভব করত।
প্রায় দুবছর পর, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার মাত্র কিছুকাল আগে দুজনের মধ্যে প্রথম কথা হলো। তাপস জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের টেস্ট কবে থেকে?
এই তো আগামী পনেরোই থেকে শুরু। একটু থেমে পালটা প্রশ্ন এলো, আপনাদের?
সতেরোই, বুধবার থেকে।
এমনি করে মন্থর গতিতে অত্যন্ত সংযতভাবে এগিয়ে চলেছিল দুটি জীবন। টেস্ট আরম্ভ হলো, শেষ হলো। একদিন ফাইন্যাল পরীক্ষা আরম্ভ হলো, শেষ হলো। তাপস ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে স্কটিশ চার্চেই বি-এ পড়া শুরু করল। ক্লাস আরম্ভ হবার পরই লেক মার্কেট বাসস্টপে খুঁজেছিল সেই পরিচিতার মুখ, কিন্তু পায়নি। ভেবেছিল হয়তো আর কোনদিন তার দেখা পাবে না। হয়তো একটু হতাশ হয়েছিল, হয়তো চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাসও পড়েছিল সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু বিধাতাপুরুষের খামখেয়ালীর খেলা পূর্ণ করবার জন্য অকস্মাৎ আবার দুটি প্রাণের, দুটি মনের সাক্ষাৎ হয়েছিল ঐ লেক মার্কেট স্টপেই।
দীর্ঘদিনের অদর্শনের বেদনা বোধকরি দুটি প্রাণে একই সুরে, একই তালে, একই সময় বেজে উঠেছিল। দুজনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, আরে, আপনি যে! দুজনেই হেসে ফেলেছিল, দুজনেই লজ্জা পেয়েছিল। বাস-স্টপের অন্যান্য যাত্রীদের চাপা অথচ বিশেষ অর্থমূলক হাসি দুজনকে আরো বেশী লজ্জিত করেছিল।
পাঁচই আগস্টও দুজনে কলেজে এসেছিল, কিন্তু হঠাৎ সেদিন সারা কলকাতায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। কলেজের ফটক থেকে ছেলেমেয়েরা ফেরত গেল। ইতিমধ্যে খবর এলে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথায় স্টেটবাসে আগুন লেগেছে, ইউনিভার্সিটির সামনে পুলিশ গুলী ছুঁড়েছে, বৌবাজারে টিয়ারগ্যাস ফাটছে। ব্রাহ্মণের রাগ ও খড়ের আগুনের মতো কলকাতা শহরটাও মাঝে মাঝেই দপ করে জ্বলে ওঠে। একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সেদিনও এমনি করেই কলকাতা জ্বলে উঠেছিল।
হেদুয়ার কোণায় ছেলেমেয়েদের ভীড়ের মধ্যে আবার দুজনের দেখা।
বাড়ি যাবেন না?
নিশ্চয়ই যাব।
তবে চলুন না!
কিসে যাব বলুন? ট্রাম নেই, বাস নেই, ট্যাক্সি নেই, রিক্সা নেই, কি করে যাব?
তাপসের কথায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠল লীনার কপালে, উজ্জ্বল দুটো চোখ ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। দু-চার মিনিট দুজনেই চুপচাপ থাকার পর লীনা প্রস্তাব করল, চলুন, সার্কুলার রোডের দিকে যাই।
চলুন।
সেই দিনটির কথা তাপস-লীনার পক্ষে জীবনেও ভোলা সম্ভব নয়। সার্কুলার রোডে এসে যে রিক্সাওয়ালা শিয়ালদ’ পর্যন্ত যেতে রাজী হয়েছিল, রাজাবাজারের মোড়ে পুলিসের গুলী দেখে সে রিক্সা ফেলে দৌড় মারল একটা দোকানের মধ্যে। লীনার হাত ধরে তাপসও আশ্রয় নিয়েছিল আর একটা দোকানের দোরগোড়ায়। প্রায় আধ ঘণ্টা পর দুজনে আবার নেমেছিল কিন্তু এবার আর কপালে একটা রিক্সাও জুটল না। হাঁটতে হাঁটতে এলো শিয়ালদ’। আবহাওয়াটা খুব থমথমে হলেও কোন গোলাগুলি চলছিল না তখন। অতি সন্তর্পণে শিয়ালদ’ পার হলো, পার হলো বৌবাজারের মোড়।
মৌলালীর কাছাকাছি আসতেই আবার দপ করে জ্বলে উঠল সারাটা অঞ্চল। কিছু লোক পুলিশের গাড়িতে ইট-পাটকেল ছুঁড়তেই পুলিশের উত্তর এলো টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ে! দার্জিলিংয়ের মতো সারাটা রাস্তা টিয়ারগ্যাসের মেঘে ঢেকে ফেলল সারাটা অঞ্চল। ঐ অন্ধকারের মধ্যেই একটা টিয়ারগ্যাস শেল এসে পড়ল ওদের দুজনের কয়েক হাত দূরে। লীনা চিৎকার করে জড়িয়ে ধরেছিল তাপসকে। রুমাল দিয়ে লীনার চোখ দুটো চেপে ধরে তাপস লীনাকে নিয়ে পাশের কর্পোরেশনের ওয়ার্কশপে গিয়ে ভিক্ষা করে একটু জল যোগাড় করে লীনার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিল। রুমালটাও ভিজিয়ে নিয়েছিল।
কিছুক্ষণ বাদে সি-আই-টির নতুন রাস্তা ধরে আবার দুজনে হাঁটতে শুরু করেছিল। কিছুদূর চলার পর লীনা প্রশ্ন করল, আপনি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত?
আপনার চাইতে কম।
একটু থেমে আবার লীনা প্রশ্ন করে, একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবেন?
আপনার বুঝি খেতে ইচ্ছে করছে?
লিণ্টন স্ট্রীটের কাছাকাছি এসে একটা পানের দোকান খোলা পাওয়া গেল। দু-বোতল কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়ে দুজনে আবার চলা শুরু করল। পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে এসে লীনা প্রস্তাব করল, চলুন, একটু বিশ্রাম করি, আর যেন পারছি না।
চলুন।
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হতে চলেছে। সূর্যের তেজে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। পাম গাছের ছায়ায় দুজনে অনেকক্ষণ বসে ছিল। নিজেদের সুখ-দুঃখ, মন প্রাণের কোন কথা সেদিন হয়নি, কথা হয়েছিল শুধু পড়াশোনার, কলেজের ক্লাসের, প্রফেসরদের।
অনেকক্ষণ পর তাপস প্রশ্ন করেছিল, আপনার বাবা মা নিশ্চয়ই আপনার জন্য খুব চিন্তা করছেন।
হ্যাঁ, তা একটু করছেন বৈকি। একটু থেমে, একটু হেসে টিপ্পনী জুড়ল লীনা, হাজার হোক মেয়ে তো, তার ওপর বয়স হয়েছে!
তা তো বটেই।
একটু পরে পালটা প্রশ্ন আসে, আপনার বাবা মাও নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছেন, তাই না?